স্টেট ব্যাঙ্কে একটি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। তাতে গত ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত জমার পরিমাণ প্রায় ১৬ কোটি টাকা। ব্যাঙ্কের খাতায় অ্যাকাউন্টের মালিক নিরুপম সেন ও বিমান বসু। ঠিকানা: ৩১, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। অর্থাৎ, সিপিএমের রাজ্য দফতর।
আলিমুদ্দিনের কাছেই ব্যাঙ্কের একটি শাখায় ওই অ্যাকাউন্টটি চলেছে বছরের পর বছর। বড় অঙ্কের লেনদেনও হয়েছে নিয়মিত। শুধু ২০১৩-র জানুয়ারি, মার্চ বা এপ্রিল মাসের এক-একটি দিনেই ১৫/১৬ লক্ষ টাকা করে জমা পড়েছে। দুই শীর্ষনেতার নামে চললেও অ্যাকাউন্টটি দলের রাজ্য কমিটির বলেই জানাচ্ছে সিপিএম।
কিন্তু দুই পলিটব্যুরো সদস্যের নামে এত বিপুল টাকার একটি অ্যাকাউন্ট কী ভাবে কাজ করেছে? ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের যাবতীয় নিয়মকানুন মানা হয়েছে কি? হিসেবনিকেশ কি দেখানো হয়েছে ব্যক্তিগত আয়করের রিটার্নে? এ সবই খতিয়ে দেখতে চেয়েছে রাজ্য সরকারের অর্থনৈতিক অপরাধ সংক্রান্ত বিভাগ (বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার কারবার মোকাবিলায় বাম জমানাতেই যে শাখা খোলা হয়েছিল)।
এই ধরনের মোটা টাকার অ্যাকাউন্টে এমনিতেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের নিজস্ব নজরদারি থাকে। তবু সরকারি বার্তা পাওয়ার পরে ব্যাঙ্ক চিঠি পাঠিয়েছে আলিমুদ্দিনকে। সেই চিঠির জবাবে সিপিএমের তরফে তাদের অডিটর সংস্থা মারফত সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পাঠানো হয়েছে ব্যাঙ্কের কাছে। নথিপত্র জমা দেওয়া হয়েছে আয়কর দফতরেও। এবং তার পাশাপাশি দলে তড়িঘড়ি প্রস্তাব পাশ করিয়ে সিপিএমের লেটারহেডে চিঠি দিয়ে বিমানবাবু ও নিরুপমবাবুর নামের ওই অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে সরাসরি দলের রাজ্য কমিটির নামে।
কিন্তু প্রশ্ন তাতে কমেনি। বরং এত দিন ধরে দুই সিপিএম নেতার ব্যক্তিগত নামে কয়েক কোটি টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে রাখা, সেখানে এক এক দিনে কয়েক লক্ষ টাকা জমা পড়া, সেই অ্যাকাউন্ট পার্টির নামে ‘বদলে নেওয়া’ ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চেয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর এবং স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী দোলা সেন। তিনি অবশ্য দাবি করেছেন, “রাজনীতির লোক নয়, সাধারণ নাগরিক হিসেবেই আমি বিষয়টি জানতে চেয়েছি। দু’জনের নামে অ্যাকাউন্টে কি চুরি-জোচ্চুরি-দুর্নীতির টাকা ছিল? কেনই বা আচমকা সেই অ্যাকাউন্ট দলের নামে বদলে ফেলা হল? ওঁরা কি কিছু লুকোতে চাইছেন? সরকার বদলেছে বলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন? ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেলে জানান। মানুষের এটা জানা দরকার।”
দলের বদলে নেতাদের ব্যক্তিগত নামে অ্যাকাউন্ট রেখে দেওয়াতেই যে প্রশ্ন উঠছে, তা মেনে নিচ্ছেন সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে একই সঙ্গে তাঁদের দাবি , দুই পলিটব্যুরো সদস্যের নামে থাকা অ্যাকাউন্টটি আদতে রাজ্য দলেরই অ্যাকাউন্ট। দলের কর্মীদের লেভি সেখানে জমা পড়ে। দুই নেতার নামে থাকলেও অ্যাকাউন্টটির ‘প্রাইমারি হোল্ডার’ ছিলেন নিরুপমবাবু। তাঁর প্যান নম্বর ব্যবহার করেই সম্প্রতি দলের নামে অ্যাকাউন্ট করা হয়েছে। (ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে প্যান জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তবু দলের নামে অ্যাকাউন্ট খোলার সময় নিরুপমবাবুর প্যান-ই জমা দিয়েছে সিপিএম।) |
বাম-ব্যাখ্যা |
আটের দশক থেকে ওই অ্যাকাউন্ট আছে।
কেন্দ্রীয়
কমিটি যে আয়কর জমা দেয় এবং
নির্বাচন
কমিশনে
যে হিসাব দাখিল করে
তাতে ওই
অ্যাকাউন্টের
অডিটেড
স্টেটমেন্ট ধরা থাকে।
নিরুপম সেন |
আগে শৈলেন দাশগুপ্ত এবং আমার নামে
অ্যাকাউন্ট
ছিল। শৈলেনদার পরে নিরুপমের নাম
ঢোকানো
হয়। এখন ব্যাঙ্ককে বলেছি, দলের নামে
অ্যাকাউন্ট
করে দেওয়া হোক। এতে
বেআইনি কী হল?
বিমান বসু |
|
প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপমবাবুর কথায়, “আটের দশক থেকে ওই অ্যাকাউন্ট আছে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতি বছর যে আয়কর জমা দেয় এবং জাতীয় নির্বাচন কমিশনে যে হিসাব দাখিল করে, তার মধ্যে এ রাজ্য থেকে ওই অ্যাকাউন্টের অডিটেড স্টেটমেন্ট ধরা থাকে। এত দিন পরে সেই তহবিল নিয়ে একটা নির্বাচনের মুখে কেন অনুসন্ধান, জানি না!”
প্রবীণ বামপন্থী নেতারা বলছেন, পুরনো আমলে কমিউনিস্ট পার্টির বেআইনি ঘোষণা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকত। তেমন কিছু ঘটলে দলের তহবিল যাতে হাতছাড়া না হয়, তার জন্যই নেতাদের নামে অ্যাকাউন্ট খোলার চল হয়েছিল। সিপিএম-ও সেই পথেই হেঁটেছিল। এত দিন কোনও প্রশ্ন ওঠেনি বলে পুরনো ব্যবস্থাই চলে আসছিল। সরকার এবং শাসক দল প্রশ্ন তুলতেই বিমানবাবুরা ব্যবস্থা বদলেছেন।
সিপিএম নেতৃত্ব এই ব্যাখ্যা দিলেও নেতাদের নামে দলের অ্যাকাউন্ট রাখার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অনেকেই বলছেন, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি-সহ দেশের একাধিক রাজনৈতিক দল যদি দীর্ঘদিন ধরে দলের নামেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চালায়, তা হলে আলিমুদ্দিন কেন এত দিন অন্য পথে হাঁটল? ব্যক্তির নামে অ্যাকাউন্ট থাকলে দলের তরফে আয়কর দাখিলের সময় তার হিসেব দেখানোর ‘দায়’ থাকে কি না, বা তা আইনসঙ্গত কি না, উঠছে সেই প্রশ্নও। তা ছাড়া, যা একান্ত ভাবেই দলের টাকা, তা কোনও ব্যক্তিবিশেষের নামে থাকলে স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। তুলনা হিসেবে আসছে প্রদেশ কংগ্রেস বা তৃণমূল কংগ্রেসের নামও। তাদের সকলেরই দলের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেখানে ব্যক্তিগত ভাবে কোনও নেতা-নেত্রীর নাম নেই।
আলিমুদ্দিনের নেতারা অবশ্য দাবি করছেন, বেআইনি কোনও কাজ তাঁরা করেননি। বিমানবাবু যুক্তি দেন, “আগে শৈলেন দাশগুপ্ত এবং আমার নামে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল। শৈলেনদা’র পরে ওই জায়গায় নিরুপমের নাম ঢোকানো হয়। এখন ব্যাঙ্ককে আমরা চিঠি পাঠিয়ে বলেছি, দলের নামে অ্যাকাউন্ট করে দেওয়া হোক। ব্যাঙ্ক মেনে নিয়েছে। আমার প্যান কার্ড নেই। তাই নিরুপমের প্যান নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বেআইনি কী হল?”
সিপিএম নেতৃত্বের আরও ব্যাখ্যা, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নামে একটিই প্যান রয়েছে। আয়কর দফতরের কাছে হিসাব দাখিল করে কেন্দ্রীয় কমিটিই। রাজ্য কমিটিগুলির আলাদা কোনও প্যান নেই। পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের সর্বত্র সিপিএমের রাজ্য কমিটিগুলি তাদের অ্যাকাউন্টের (সে যে নামেই হোক না কেন) অডিটেড স্টেটমেন্ট পাঠিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে। সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, এই ভাবেই ‘স্বচ্ছতা’ রক্ষা হয়। সিপিএম সূত্র জানাচ্ছে, এত দিন পর্যন্ত রাজ্য সিপিএম-কে কেউ চেকে টাকা দিলে তা লেখা হতো ‘সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি’র নামে। তা হলে সেই চেক কি নিরুপমবাবু ও বিমানবাবুর ব্যক্তিগত নামে থাকা অ্যাকাউন্টেই জমা দেওয়া হতো? ব্যাঙ্ক তা কী ভাবে নিত এবং টাকা ওই অ্যাকাউন্টে জমা করত, সেই প্রশ্নও উঠছে। |
আরও একটি বিষয়ের যুক্তিগ্রাহ্য জবাব খুঁজছেন অনেকে। তা হল, কোনও ব্যক্তির নিজের নামের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তাঁর প্যান কার্ডের নম্বর দেওয়া থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই ব্যক্তির আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় সেই অ্যাকাউন্টের হিসাব দেখাতে হয়। এ ক্ষেত্রে নিরুপমবাবুর ব্যক্তিগত নামের ওই অ্যাকাউন্টে যে বিপুল টাকা থাকত, তার ভিত্তিতে এত দিন নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দেওয়া হয়েছে কি? নিরুপমবাবুর দাবি, এত দিন এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি।
সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট নিয়ে তদন্তের আর্জি জানিয়ে স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভনর্রকে ৯ জুলাই লেখা চিঠিতে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী দোলার বক্তব্য, “বিস্ময়কর ঘটনা হল, ‘পার্সোনাল কাস্টমার’-এর ওই অ্যাকাউন্ট হঠাৎই ‘বিজনেস কাস্টমার’ হিসেবে সিপিএমের রাজ্য কমিটির নামে করে নেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়েও তদন্তের আর্জি জানাচ্ছি।”
নিরুপমবাবুর আবার পাল্টা দাবি, “এর মধ্যে লুকোনোর কিছু নেই। বেআইনিও কিছু নেই। আগে দলের নামে অ্যাকাউন্ট খোলার অসুবিধা ছিল। তাই দলে প্রস্তাব পাশ করে নেতাদের নামে অ্যাকাউন্ট হতো। সেটাই চলে আসছিল। এখন ব্যাঙ্কের কাছ থেকে জানার পরে দলের নামে অ্যাকাউন্ট করে নেওয়া হয়েছে। দলের সদস্যদের লেভি, সংগৃহীত যাবতীয় চাঁদা জমা পড়ে ওই অ্যাকাউন্টেই। নিয়মিত অনেক টাকা জমা পড়বে বলেই ওটা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট।”
নিরুপমবাবুরা এটাও মেনে নিচ্ছেন, আরও আগেই দলের নামে অ্যাকাউন্ট না-খোলা তাঁদের তরফে গাফিলতি। বিমানবাবু বলেন, “শৈলেনদা, আমি বা নিরুপম, যারই নামে হোক একটা অ্যাকাউন্টে দলের টাকা জমা পড়ে। এতে তো কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। এখন কথাটা উঠেছে বলে দলের নামেই অ্যাকাউন্ট করে নেওয়া হয়েছে। এতে অবৈধ বা বেআইনি কী হয়েছে?” আর নিরুপমবাবুর সংযোজন, “আয়কর দফতর এবং নির্বাচন কমিশনে ওই অ্যাকাউন্টের অডিটেড স্টেটমেন্ট বছর বছর দেওয়া হচ্ছে। ব্যাঙ্কও এই নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেনি। এখানে ভুল বা গাফিলতি যদি কিছু হয়ে থাকে, সেটা হল অ্যাকাউন্টটা আগেই দলের নামে করে না-নেওয়া।”
তবু ব্যক্তি এবং দল— অ্যাকাউন্টের এই টানাপোড়েনই আপাতত প্রশ্নের মুখে ফেলেছে আলিমুদ্দিনকে! |