রুপোলি-ধূসর হ্যাচব্যাক গাড়ির বনেটে বসে বিয়ার খাচ্ছিলেন তিন যুবক। গলার স্বর উচ্চগ্রামে, সঙ্গে অশালীন শব্দের নিরন্তর ব্যবহার। রাত তখন ১১টা বেজে গিয়েছে। বালিগঞ্জ প্লেসের একটি রেস্তোরাঁয় স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে খেতে গিয়ে সেখানেই নিজের সেডান রেখে গিয়েছিলেন হাজরা রোডের বাসিন্দা এক চিকিৎসক। খাওয়াদাওয়া সেরে বেরিয়ে দেখেন ওই কাণ্ড। স্ত্রী, মেয়েদের নিয়ে ওই উন্মত্ত যুবকদের সামনে দিয়ে গাড়িতে উঠতে ভয়ই করছিল তাঁর। কারও সাহায্য চাইবেন, সে উপায়ও নেই। গোটা তল্লাট সুনসান। কোনও পুলিশ নেই। শেষ পর্যন্ত তাঁদের কোনও বিপদ হয়নি। কিন্তু বেশি রাতে ওই এলাকায় থাকার ঝুঁকি আর নেওয়া যাবে না, তা বুঝে গিয়েছে ওই পরিবার।
সম্প্রতি গুরুসদয় দত্ত রোডে রাতে বন্ধুদের সঙ্গে খেতে গিয়ে প্রায় একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন বহুজাতিক সংস্থার কর্মী এক তরুণী। কয়েক জন মত্ত যুবক তাঁদের পথ আগলে দাঁড়ায়। অবশ্য তাঁরা দলে ভারী ছিলেন বলে এবং রেস্তোরাঁর নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরা এগিয়ে আসায় হটে যায় নেশাখোরেরা। |
রাতপথে চলছে নজরদারি। ছবি: সুমন বল্লভ |
বালিগঞ্জ প্লেস, গুরুসদয় দত্ত রোড, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, কসবা-বাইপাস কানেক্টর, শরৎ বসু রোড ও দেশপ্রিয় পার্কের আশপাশ, লেক গার্ডেন্স ও প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড এলাকাশহরের মধ্যে নতুন নতুন বিনোদনের এলাকা গড়ে ওঠায় সে সব জায়গায় রাতে নাগরিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যে কলকাতা পুলিশের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে, লালবাজারের কর্তারা সে কথা স্বীকার করছেন। তাই শীঘ্রই রাতে টহলদার পুলিশের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। কলকাতা পুলিশের কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। দিনে রাজপথে থাকেন হাজার পাঁচেক পুলিশ। সেখানে রাতের রাজপথে মোট ১২০০-র বেশি পুলিশ থাকেন না। এই সংখ্যাটাই দ্বিগুণ করতে চাইছে লালবাজার।
কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষকর্তার কথায়, “একটা সময়ে কলকাতার খানাপিনা ও আমোদ-প্রমোদের জায়গা বলতে মূলত ছিল পার্ক স্ট্রিট ও ধর্মতলা চত্বর। কিন্তু ইদানীং শহরের বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে। একটা সময়ে যা ছিল নিছক বসত এলাকা, সেই জায়গার চরিত্র পাল্টে গিয়েছে। এ কথা মাথায় রেখেই রাতের শহরে নজরদারিতে বদল আনা হচ্ছে।”
সদ্য গঠিত রাতের টহলদার বাহিনীতে এক জন সাব-ইনস্পেক্টরের নেতৃত্বে ১১ জন মহিলা পুলিশের একটি দল রাখা হয়েছে। রাতের শহরে মহিলাদের তল্লাশি করার ক্ষেত্রে যাতে সমস্যা না-হয়, সে জন্যই এই প্রথম এমন একটি দল হয়েছে।
রাতের শহরের নিরাপত্তার জন্য মাসখানেক আগেই পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ-র নির্দেশে ‘ক্লাস্টার মোবাইল পোলিসিং সিস্টেম’ চালু হয়েছে। ট্রাফিক, সশস্ত্র বাহিনী-সহ বিভিন্ন বিভাগ থেকে নিয়ে মোট ২০০ পুলিশকর্মীর একটি বাহিনী হয়েছে। এই বাহিনীরই অন্তর্গত মহিলা পুলিশের দল। শহরের বিভিন্ন ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনারদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে রাত সাড়ে ৯টা থেকে ভোর সাড়ে তিনটে পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট এলাকা ও লাগোয়া জায়গায় আচমকা তল্লাশিতে নামছে ওই বাহিনী। কলকাতার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (৩) দেবাশিস রায় বলেন, “সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাস্তব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশি ব্যবস্থাকে আধুনিক রূপ দেওয়া হয়েছে।”
একই সঙ্গে লেনিন সরণি, এজেসি বসু রোড, পার্ক স্ট্রিট, জওহরলাল নেহরু রোড, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড-- প্রায় ২৫ বর্গকিমি বিস্তৃত এলাকাকে কলকাতার ‘কোর এরিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করে রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টে পর্যন্ত ৩০০ পুলিশের একটি বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। লালবাজার কর্তাদের দাবি, ওই এলাকায় রাজপথে প্রতি ২০০-৩০০ মিটার অন্তর পুলিশ মিলছে। এক অফিসারের মন্তব্য, “রাতের শহরে অপরাধ বেশি হয় মধ্য-দক্ষিণ কলকাতার ওই বর্গাকার এলাকায়। পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণ-কাণ্ডও ওই এলাকারই ঘটনা।”
কিন্তু অফিসারদের একাংশের মত, শহরের মধ্যেই নতুন ছোট ছোট ‘কোর এলাকা’ হয়েছে। ওই সব জায়গায় অপরাধ হচ্ছে কিন্তু সব অভিযোগ নথিভুক্ত করাতে চাইছেন না ভুক্তভোগীরা। তাই ওই সব এলাকাতেও এখনই খুব বেশি সংখ্যায় না-হলেও রাতভর স্থায়ী পুলিশি টহলদারি প্রয়োজন। সে জন্যই রাতের রাজপথে আরও বেশি সংখ্যায় পুলিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। |