গত সপ্তাহে বিশ্ব বাজারে আবার দেখা গেল ‘বার্নানকে ম্যাজিক’। মার্কিন অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরার ইঙ্গিতে মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড)-এর কর্ণধার বার্নানকে আর্থিক ত্রাণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হতে পারে বলে মন্তব্য করেন কয়েক সপ্তাহ আগে। এর জেরে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল বহু দেশের অর্থনীতিতে। শেয়ার বাজারে ধস নেমেছিল বিশ্বময়। মার্কিন মুলুকে ডলার বর্ষণ কমলে ডলার সরবরাহ কমতে পারে বহু দেশে। এই আশঙ্কায় সঙ্কুচিত হয়েছিল শেয়ার সূচক। এ বার হল ঠিক তার উল্টো।
গত সপ্তাহে বার্নানকে মন্তব্য করেন, দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে আর্থিক ত্রাণ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না। হঠাৎ এই বিপরীত মন্তব্যে যেন আগুনে ঘি পড়ে। ডলার প্রবাহ কমবে না, এই আশায় তপ্ত হয়ে ওঠে বিশ্ব বাজার। বৃহস্পতিবার সেনসেক্স ওঠে ৩৮২ অঙ্ক, অর্থাৎ প্রায় ২%। লগ্নিকারীদের খাতায় যোগ হয় কম-বেশি ১ লক্ষ কোটি টাকা। বাজার ওঠে পরের দিনও। শুক্রবার সূচক বাড়ে আরও ২৮২ পয়েন্ট। অনেক দিন পরে আবার পৌঁছয় ২০ হাজারের দোরগোড়ায় (১৯,৯৫৮ অঙ্ক)। ৬,০০০ অঙ্কের বাধা পেরোয় নিফ্টিও। শেয়ারের এই উত্থান-পতন আবারও স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিল মার্কিন অর্থনীতির উপর এখনও বিশ্ব অর্থনীতি কতটা নির্ভরশীল।
মাত্র দু’দিনে সূচক ৬৬৪ পয়েন্ট ওঠায় সপ্তাহের শেষে স্বস্তি পাওয়া গেলেও পাকাপাকি আনন্দের কোনও কারণ নেই। বিদেশের বার্তা সূচককে খাড়া করে রাখলেও অভ্যন্তরীণ কারণে খুঁটি কিন্তু আদৌ মজবুত নয়। দেশীয় অর্থনীতিতে ভালর থেকে খারাপ খবরের প্রবাহই যেন বেশি। শুক্রবার বাজার বন্ধ হওয়ার পরে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী কমেছে শিল্পোৎপাদন, সঙ্কুচিত হয়েছে রফতানি, পরপর ৮ মাস গাড়ি বিক্রি নীচের দিকে, খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ফের ১০% ছুঁইছুঁই। আশার তুলনায় ইনফোসিসের ভাল ফলাফল ছাড়া বাকি সবই কালো ছায়া ফেলবে বাজারে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী মে মাসে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি তো হয়ইনি, বরং কমেছে ১.৬%। গত ১১ মাসে এটিই সবথেকে কম। এই তথ্য স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো এখনও দূর অস্ত্। জুন মাসে কমেছে রফতানিও। একই মাসে খুচরো বাজারে ঘটেছে মূল্যবৃদ্ধি। এই সব পরিসংখ্যানের প্রভাব অবশ্যই পড়বে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৩০ জুলাইয়ের ঋণনীতিতে। এই পরিসংখ্যান দেখে অনেকেরই আশঙ্কা, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসের কোম্পানি ফলাফল হয়তো তেমন ভাল হবে না।
জুন মাসে যাত্রী গাড়ি বিক্রি কমেছে ৯%। গাড়ি শিল্পের কাছে তো বটেই, গোটা অর্থনীতির কাছেও এটি শুভ ইঙ্গিত নয়। জুনে মোটর সাইকেল বিক্রিও কমেছে ৯.১৬%। বিক্রি বেড়েছে স্কুটারের। মনে রাখতে হবে, গাড়ি শিল্পের উপর অন্য অনেক শিল্প নির্ভরশীল। পরিস্থিতি যা, তাতে বিশ্ব বাজার শক্তি না-জোগালে সোমবার সেনসেক্স বেশ খারাপ জায়গাতেই খোলার সম্ভাবনা। অর্থাৎ এই ধাক্কায় ২০ হাজার হয়তো আমাদের দেখা হবে না। শেষ দু’দিনে বাজার এতটা ওঠার পর যাঁরা শেয়ার এবং মিউচুয়াল ইউনিট বিক্রির কথা ভাবছিলেন, তাঁদের হয়তো আবার হতাশ হতে হবে।
জুন মাসে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার ৯.৩১% থেকে বেড়ে পৌঁছেছে ৯.৮৭ শতাংশে। অন্য দিকে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ১০.৬৫% থেকে বেড়ে হয়েছে ১১.৮৪%, যা খুবই চিন্তার কারণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মে মাসে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৪.৭%, যা গত সাড়ে ৩ বছরে সবচেয়ে কম। এই বিপরীত- মুখী পরিসংখ্যানে অবাক অনেকেই।
এতটা প্রতিকূলতার মধ্যে একমাত্র ভাল খবর, ইনফোসিসের ভাল ফলাফল প্রকাশ। শুক্রবার সকালে দেশের অগ্রণী এই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা প্রকাশ করে ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসের ফলাফল। এই মেয়াদে সংস্থার মোট আয় ১১,২৬৭ কোটি টাকা, যার উপর নিট মুনাফা হয়েছে ২,৩৭৪ কোটি টাকা। আশার তুলনায় ফলাফল ভাল হওয়ায় বাজার খুশি। শুক্রবার ইনফোসিস শেয়ারের দর ২৭৬ টাকা অর্থাৎ ১০.৯২% বেড়ে পৌঁছয় ২,৮০৩ টাকায়। এই ফলাফলের ভাল প্রভাব পড়ে টিসিএস শেয়ারেও। ওই দিন টাটা গোষ্ঠীর এই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার শেয়ার দর ৪৬ টাকা বেড়ে পৌঁছে যায় ১,৬০৬ টাকায়। এই সাময়িক খুশির আবহাওয়া বাজার ধরে রাখতে পারে কি না, তাই এখন দেখার। |