মুখ পাল্টাবেন বলে ট্যাংরা-পাবদা কিনতে গেলেন। ফিরলেন মুখ চুন করে। দাম যে আগুন!
হাতে ছ্যাঁকা লাগা আমবাঙালির অগত্যা ভরসা সেই চালানি রুই-কাতলা কিংবা চারা পোনা। তারও দর হেলাফেলার নয়। কলকাতার অধিকাংশ বাজারে এখন চার-পাঁচ টুকরো অন্ধ্রের চালানি কাতলা কিনতে গেলেও ৮০-৯০ টাকা পড়ছে!
বস্তুত গত ক’মাসে প্রায় প্রতিটা বাজারে মাছের দাম এমন বেড়ে গিয়েছে যে, ট্যাঁকের যথেষ্ট জোর না-থাকলে রোজের পাতে মাছ জোটানোই কঠিন। সাধারণ মানুষের আক্ষেপ, ভাল ইলিশ তো আগেই নাগাল এড়িয়েছে। ইদানীং ট্যাংরা-পাবদা-মৌরলা-চিংড়ি-চিতল বা ভেটকি-পার্শের মতো কুলীনেরাও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে দামের সিঁড়ি বেয়ে। বিক্রেতারা সাফ বলে দিচ্ছেন, আড়তে মাছ-ই মিলছে না! যা আসছে, তার দাম এমন তো হবেই!
ফলে উত্তরের দমদম থেকে দক্ষিণের টালিগঞ্জ মাছ বাজারে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে আমগেরস্তের দীর্ঘশ্বাস। দাম যে লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছে, সে খবর পৌঁছেছে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ঘরেও। মাছের জোগান বাড়ানোর লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি টাস্ক ফোর্সও গড়ে দিয়েছেন। আপাতত স্থির হয়েছে, কৃষি ও সেচ দফতরের বিভিন্ন জলাভূমিতে নানা ধরনের মাছের চাষ করা হবে। ইলিশ আনা হবে মায়ানমার থেকে।
কিন্তু এ সব এখনও খাতায়-কলমে। মাছের দামে লাগাম পরানোর উপায় এই মুহূর্তে মহাকরণের অধরা। কিছু দিন আগে সব্জির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বেশ ক’টা বাজারে সরকারি অভিযান চালানো হয়েছিল। তবে মাছ-বাজারে সরকারি কর্তাদের দেখা এ যাবৎ মেলেনি। তাই মূল্যবৃদ্ধির রকম-সকম নিয়ে কোনও প্রাথমিক রিপোর্টও মৎস্য দফতরের হাতে নেই বলে মহাকরণের খবর। যদিও মৎস্য দফতর কয়েকটি বাজারে সস্তায় চারা পোনা বেচতে শুরু করেছে। মানিকতলা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক তথা মুখ্যমন্ত্রীর টাস্ক ফোর্সের অন্যতম সদস্য প্রভাত ঘোষ নিজেও বলছেন, “মাছের দাম যে ভাবে বাড়ছে, তা চিন্তার বিষয়। কিন্তু এই মুহূর্তে দাম নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার কারও কাছে নেই।” তাঁর মতে, মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যে মাছের উৎপাদনবৃদ্ধির হরেক উপায় ভাবলেও হাতে-নাতে ফল পেতে অন্তত দু’-তিন বছর লাগবে।
কিন্তু এ হেন আকালের কারণ কী? পাইকারি মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির কর্তা উত্তম হাজরার দাবি, এ জন্য দায়ী জোগানের ভাঁটা। “বাংলাদেশি ইলিশ আমদানি এমনিতেই বন্ধ। কিন্তু ইলিশ ছাড়াও ও-পার থেকে প্রচুর যে ট্যাংরা-পার্শে-ভেটকি আসত, আপাতত তা-ও বন্ধ। এখানে যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তাই চড়া দামে আমাদের কিনতে হচ্ছে।” বলছেন উত্তমবাবু। তাঁর বক্তব্য, “রথযাত্রার জন্য ওড়িশার মাছ আসছে না। আবার অন্ধ্রের রুই-কাতলারও পাইকারি দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে বাজারে ঘোর আকাল।” বাড়তি তোলাবাজির দিকেও আঙুল তুলছেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের একাংশ। যাঁদের অভিযোগ, মাছের লরিপিছু তোলা দিতেই ১২০০-১৫০০ টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই তার আঁচ পড়ছে ক্রেতার উপরে। সল্টলেকের মাছ-ব্যবসায়ী কৃষ্ণ মাঝির আক্ষেপ, এক শ্রেণির ব্যবসায়ীই এখন সুস্বাদু ও কদরদার মাছের দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। “পাইকারি-দর চড়লেও খদ্দের ধরে রাখার তাগিদে আমাদের কিনতেই হচ্ছে। দাম না-বাড়িয়ে উপায় কী?” মন্তব্য কৃষ্ণবাবুর। উপরন্তু বাঙালি মেনুর ‘স্পেশ্যালিটি’ রেস্তোঁরার বাড়বাড়ন্তকেও অন্যতম কারণ হিসেবে ধরছেন ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ। এঁদের এক জনের কথায়, “এখন শহরে এমন বহু খাবার জায়গা হয়েছে। সেখানে চিংড়ির মালাইকারি, ভেটকি পাতুরি থেকে শুরু করে চিতলের মুইঠ্যা, তোপসে-মৌরলা ভাজা, সর্ষে পার্শে, মায় কচুর শাকে ইলিশও পাওয়া যায়। পাইকারি বাজার থেকে এই সব মাছের বড় অংশ ওখানে চলে যাচ্ছে। পকেটে রেস্ত থাকলে লোকে গিয়ে খেয়ে আসছেন। মামুলি গৃহস্থ বাজার থেকে ফিরছেন খালি হাতে।”
তবে মাছের আকালের জন্য শুধুই বাজারি-কারণকে দায়ী করতে নারাজ মৎস্য-বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ। ওঁদের যুক্তি: চাহিদা বাড়লেও খাল-বিল-নদীতে মাছ কমে যাওয়াটাও বড় কারণ। কেন কমছে?
ওঁরা একাধিক কারণ দর্শিয়েছেন। যেমন, বড় নদী বা সমুদ্রে ছোট ফুটোর জালে দেদার মাছ-শিকার চলছে। বহু চারা তাতে আটকে মারা যাচ্ছে, বড় হতে পারছে না। অনেকের মতে, ভূগর্ভ থেকে যথেচ্ছ জল তুলে নেওয়ায় বছরের সিংহভাগ সময়ে নদী-খাল-বিল-পুকুরে যথেষ্ট জল থাকছে না, এমনকী কখনও শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক নিয়মে সেখানে মাছের জন্ম ও বাড়বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। সঙ্গে জুড়েছে দূষণের সার্বিক প্রভাব। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে মিষ্টি জলের মাছ।
কারণ যা-ই থাক, প্রশাসনের কি কিছুই করার নেই?
ক্রেতারা তো বটেই ব্যবসায়ী মহলেও এখন সেই প্রশ্ন। বাম জমানার মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দের দাবি, তাঁর আমলে এ দিকে সরকারের নজর ছিল। রবিবার তিনি বলেন, “আমার সময়ে দফতরের অফিসারেরা নিয়মিত পাইকারি ও খুচরো বাজারে নজরদারি চালাতেন।” বর্তমান মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ এ দিন বলেন, “আমরা জানি, পাইকারি ও খুচরো দামের অস্বাভাবিক ফারাক হচ্ছে। কিন্তু বাজারে নজরদারির জন্য কৃষি দফতরের যে স্পষ্ট আইন আছে, মৎস্য দফতরের ক্ষেত্রে তা নেই।” তা হলে উপায়?
চন্দ্রনাথবাবুর জবাব, “তবু আমরা চেষ্টা করছি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে টিম গড়া হয়েছে। বাজারে-বাজারে ঘুরে দেখা হবে, এই পরিস্থিতি কেন হল।” পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও প্রশাসনিক সূত্রের খবর, বাংলাদেশ থেকে ট্যাংরা-পাবদা-ভেটকি ইত্যাদির আমদানি ফের যাতে শুরু হয়, তারও তোড়জোড় চলছে। তবে বাংলাদেশি মাছ যদি ঢোকেও, তা শুরু হতে হতে আরও অন্তত সপ্তাহখানেক। তার মধ্যে রাজ্যের নিজস্ব জোগান বা ভিন রাজ্যের চালানবৃদ্ধির আশা ব্যবসায়ীরা বিশেষ করছেন না।
অতএব, মৎস্যবুভুক্ষু আমবাঙালির দুর্দশা অবসানের আশু লক্ষণ নেই। লেক মার্কেটের কাছে থাকেন অর্ধেন্দু সরকার। বেসরকারি সংস্থার ওই কর্মী জানান, দুধের স্বাদ তাঁরা ঘোলে মেটাতে বাধ্য হচ্ছেন। বাড়িতে আনতে হচ্ছে সস্তা লটিয়া। বা আমোদি বা সামুদ্রিক মৌরলা। তা-ও না-পেলে কৃত্রিম তেলাপিয়া, ছোট নাইলনটিকা বা জাপানি পুঁটির মতো ‘কাগুজে স্বাদের’ মাছ। “পাবদা-ট্যাংরার প্রশ্ন নেই। এক বেলার মাছেই যদি পাঁচশো টাকা বেরিয়ে যায়, তা হলেও তো মনে হবে, নোটগুলো চিবিয়ে খাচ্ছি!” খেদ করছেন অর্ধেন্দুবাবু। সরকারি নজরদারিতে কবে হাল শুধরোবে, সেই আশায় দিন গুনছেন ওঁরা।
|
আগুন বাজার |
 |
|
মাছ |
দাম |
ইলিশ (বড়) |
১২০০ |
ইলিশ (মাঝারি) |
৮০০ |
ট্যাংরা |
৬০০ |
বাগদা চিংড়ি |
৫০০ |
গলদা চিংড়ি |
৭০০ |
পার্শে (ছোট) |
৩৫০ |
মৌরলা |
৪০০ |
পাবদা |
৪৫০ |
গুরজালি |
৪০০ |
ভেটকি |
৪৫০ |
* প্রতি কেজির গড় দাম, টাকায় |
|