এক দিকে আশার জাল বিছোনো। অন্য দিকে বাস্তবতা। তার ফাঁক গলেই বাঙালির পাত থেকে উধাও হচ্ছে ইলিশ!
কলকাতার বাজারে বাংলাদেশের ইলিশ সে ভাবে আসেনি এ মরসুমে। যেটুকু আসছে, তা চোরাপথে। অগত্যা সংখ্যায় কম এবং দামে আগুনছোঁয়া। সরকারের আশা, বাংলাদেশের ইলিশ না আসুক, আসবে মায়ানমারের ইলিশ। খোদ মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বলে ইলিশ আনার চেষ্টা করে চলেছেন। মায়ানমার থেকে ইলিশ আমদানির কথা হয়েছে। আগামী অক্টোবর মাস থেকে সেই ইলিশ বাজারে আসতে শুরু করবে।”
অথচ সেই আশাতে জল ঢেলেছেন বিক্রেতারাই। তাঁদের মতে, মায়ানমারের মোহনার ইলিশ ইতিমধ্যেই কলকাতার বাজারে দু’এক জায়গায় এসেছে। তবে তার স্বাদও তেমন নয়। সঙ্গে মায়ানমার থেকে বিমান বা জাহাজে ইলিশের আমদানির খরচও অনেক বেশি। ফলে সেই ইলিশের দামও বেশ চড়া। |
আবার, সরকারের ইচ্ছে সাধ্যের মধ্যেই বাঙালির পাতে সুস্বাদু ইলিশ দেওয়ার। অথচ খোদ মৎস্যমন্ত্রীই স্বীকার করছেন, “আশা করা যায় বছর দুয়েকের মধ্যে আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীকে কম দামে ইলিশ খাওয়াতে পারব।” অর্থাৎ, বছর দুয়েকের আগে বাঙালির পাতের ইলিশে সাধ আর সাধ্য একজোট হওয়ার তেমন আশা দেখছে না খোদ সরকারই।
দামের আগুনে আঁচে পুড়ে তাই বাজারে কোণঠাসা ইলিশই। মানিকতলা মাছের বাজারে যেমন পাবদা, রুই-কাতলার ভিড়ে এক কোণে পড়ে ইলিশ মাছের ঝুড়ি। তবে সেই ইলিশ সাধ মিটিয়ে কেনা দূরে থাক, দাম জিজ্ঞেস করেই চমকে উঠছেন খদ্দেররা। বিক্রেতারা জানালেন, মাঝারি মানের অর্থাৎ এক কিলো ওজনের ইলিশের দাম ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। ৬০০ গ্রাম ইলিশের দাম ৮০০ টাকা।
অন্যান্য বার বর্ষার মরসুমে ইলিশ মাছের ঝুড়িই থাকত সবার আগে। আর সব মাছ থাকত পেছনের সারিতে। এ বার ছবিটা ঠিক উল্টো। শুধু মানিকতলা বাজারই নয়, গড়িয়াহাট, লেক মার্কেট, কলেজ স্ট্রিট বাজারে সর্বত্র একই হাল। বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, ভরা
বর্ষায় যে পরিমাণ ইলিশ থাকার কথা, তার ১০ শতাংশও নেই বাজারে। মানিকতলা বাজারে ইলিশ কিনতে আসা এক ক্রেতা বলেই ফেললেন, “এই মরসুমে ইলিশ কেনা মানে তো সোনা কেনার সমান!”
বিক্রেতারা জানালেন, গত বারও বাজারে ইলিশ কম ছিল। কিন্তু এ বারের মতো নয়। হাওড়ার পাইকারি মাছ বাজারের ফিশ ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অতুল দাস বলেন, “গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশ থেকে ২৫০ টন ইলিশ কলকাতার বাজারে এসেছিল। এ বছর বাংলাদেশ থেকে সেটুকু ইলিশও আসেনি। যেটুকু যা মিলছে, তা আসছে চোরাপথে। চোরাপথে ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন।” গড়িয়াহাট বাজারের এক ইলিশ বিক্রেতা জানালেন, কলকাতার বাজারে যেটুকু ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, তার বেশির ভাগই বাংলাদেশের।
তবে বাংলাদেশের সেই ইলিশেরও স্বাদ তেমন ভাল নয় বলেই জানালেন ক্রেতারা। মানিকতলা বাজারের এক ইলিশ বিক্রেতা প্রদীপ মণ্ডল বলেন, “বাংলাদেশের যে ইলিশ বাজারে এসেছে, তার বেশির ভাগটাই অসময়ে ধরা।” তবে শুধু বাংলাদেশের ইলিশই নয়, বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, এ রাজ্যের যে সব জায়গা থেকে ইলিশ পাওয়া যেত, সেই কোলাঘাট, দিঘা, নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ থেকেও এ বার বাজারে ইলিশ আসেনি বললেই চলে। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, মোহনায় জাল দিয়ে ছোট ছোট ইলিশ ধরে ফেলার প্রবণতা খুব বেড়ে গিয়েছে। ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীতে এসে ডিম পাড়ে। মোহনায় জন্মানো ছোট ইলিশ অনেক মৎস্যজীবীরা ধরে ফেলছেন। এমনকী ডিম-ভর্তি ইলিশও ধরে ফেলার প্রবণতাও বেড়েছে। এই প্রবণতা রুখতে মৎস্যবন্দরগুলোয় রাজ্য সরকারের কড়া নজরদারি থাকা জরুরি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “আমাদের রাজ্যে যে সব জায়গা থেকে ইলিশ মেলে, সেখান থেকে যেন ছোট অবস্থায় ইলিশ ধরা না হয় এ ব্যাপারে মৎস্যজীবীদের সচেতন করা হচ্ছে। মৎস্যজীবীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ছোট ইলিশ ধরবেন না।” |