বাসের ভাড়া না বাড়ানোর ‘জনপ্রিয়’ রাজনীতির ফলাফল যে কী ধরনের হতে পারে, তার উদাহরণ মিলছে ব্যারাকপুরের ৭৮ নম্বর রুটে।
কমিশন বাড়ানোর দাবিতে গত ৬ জুলাই থেকে ওই রুটে বাস চালানো বন্ধ রেখেছে সিপিএম এবং তৃণমূল, উভয় দলের শ্রমিক সংগঠনই। আর কর্মীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মালিকদের বক্তব্য, দিন দিন জ্বালানি থেকে যন্ত্রাংশ সবেরই দাম বাড়ছে। সেই আন্দাজে বাসের ভাড়া বাড়ছে না। বাস চালিয়ে আয় না হলে কর্মীদের বেতন কী করে বাড়াব?
অতীতে ৭৮ নম্বর ছাড়াও ওই রুটে বাস ছিল ৭৮এ, ৭৮ এ/১, ৭৮বি, ৭৮ সি এবং ৭৮ই। এখন এই সব রুট বন্ধ হয়ে গিয়ে শুধুমাত্র বেঁচে রয়েছে ৭৮ এবং ৭৮ এ/১। বাসমালিকদের বক্তব্য, বাসভাড়া না বাড়ার কারণেই ক্রমশ লাভ কমেছে। ক্ষতি সামাল দিয়ে বাস চালাতে না পেরে একে একে সব রুটই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এ বার কর্মীদের আন্দোলনের ফলে পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হওয়ার পথে ৭৮ নম্বর রুটও। গত ৬ জুলাই থেকে কমিশন বাড়ানোর দাবিতে প্রায় চারশো কর্মী আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনে এককাট্টা হয়ে যান তৃণমূল এবং সিপিএম, উভয় দলের শ্রমিক সংগঠনের কর্মীরাই। কর্মী সংগঠনগুলি সূত্রের খবর, ওই দিন দুপুরে কর্মীরা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেন। তার পরেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, কমিশনের পরিমাণ না বাড়ানো হলে একটি বাসও তাঁরা চালাবেন না। বাস মালিকদের আশঙ্কা, ৭৮-এর এই প্রবণতা অন্যান্য রুটেও ছড়াতে পারে। |
এ দিকে পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, ভাড়া যে বাড়বে না, তা সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন পরিবহণ দফতরের কর্তারা। মহাকরণের এক কর্তার কথায়, “সহজ অঙ্কে জ্বালানির খরচ বাড়লে বাসভাড়া বাড়া উচিত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কোনও অবস্থাতেই ভাড়া বাড়াতে নারাজ।” কিন্তু কেন? তার উত্তর দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার। তাঁর মতে, “এখন ভাড়া বাড়ালে নিশ্চয়ই বেশির ভাগ মানুষের অসুবিধে হবে, তাই সরকার ভাড়া বাড়াচ্ছে না। এই পরিস্থিতি পাল্টালে সরকারও বাসের ভাড়া বাড়াবে।”
৭৮ নম্বর রুটের বাস কর্মীরা জানান, এই মুহূর্তে প্রতিদিন টিকিট বিক্রির উপরে ১২ শতাংশ কমিশন পান চালকেরা, ৬ শতাংশ পান কন্ডাক্টর এবং ৪ শতাংশ কমিশন খালাসিরা পেয়ে থাকেন। আইএনটিটিইউসি পরিচালিত ৭৮ নম্বর রুটের সম্পাদক ইবরার খান বলেন, “আমরা দাবি করেছি চালক ও খালাসির এক শতাংশ করে এবং কন্ডাক্টরের ২ শতাংশ কমিশন বাড়াতে হবে। এই আন্দোলনে কোনও রং নেই। সব রাজনৈতিক দলই একজোট হয়ে দাবি জানিয়েছি।” অন্য দিকে, সিটু পরিচালিত ব্যারাকপুর বাস-মজদুর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রাণগৌর কুণ্ডু বলেন, “এখন সমস্ত কর্মী একজোট হয়ে আন্দোলন করছেন। ওখানে কোনও রাজনৈতিক দল নেই। আমাদের ওঁরা ডাকেননি। এই আন্দোলনকে সমর্থন করছি।”
মালিকেরা অবশ্য সাফ বলছেন, আয়ের ২২ শতাংশ চলে যায় কর্মীদের কমিশন দিতে। বাকি ৬০ শতাংশ যায় ডিজেলের খরচে আর ১০ শতাংশ রক্ষণাবেক্ষণে। বাকি ৮ শতাংশ তাঁদের আয়। এই অবস্থায় কী ভাবে কমিশন বাড়ানো যাবে, প্রশ্ন তুলছেন তাঁরাও। |
বাস মালিকদের সংগঠন ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটস’-এর নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট’-এর নেতা দীপক সরকারের বক্তব্য, গত বছর বাসের ভাড়া বাড়ানোর পর থেকে ৮ বার ডিজেলের দাম বেড়েছে। অথচ সরকার সেই অনুপাতে বাসের ভাড়া বাড়ায়নি। ফলে এই সমস্যা শুধু ৭৮ নম্বর রুট নয়, কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকার সমস্ত রুটেই ক্রমশ ছড়িয়ে যাবে। বাসমালিকদের প্রশ্ন, যদি বাজারে ডিজেলের দাম ঠিক হতে পারে, তা হলে বাসভাড়াই বা সরকার ঠিক করবে কেন? এক বাসমালিক বলেন, “আমরা তো অনেক দিন ধরেই বাসের ভাড়া ঠিক করার জন্য পৃথক কমিটি তৈরি করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছি।”
মহাকরণ সূত্রের খবর, বিষয়টি সমাধানে ৭৮ নম্বর রুটের বাসমালিক ও কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। তাতেও সুরাহা হয়নি। পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আপাতত ওই রুটে সরকারি বাস বাড়িয়ে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছে।”
কিন্তু সচিব যা-ই বলুন না কেন, ৭৮ নম্বর বাস সপ্তাহখানেক ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হয়রানি বেড়েছে নিত্যযাত্রীদের। গুটিকয় সরকারি বাস কোনও ভাবেই সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না।
|