সঙ্গীত সমালোচনা ১...
দূর আকাশে তোমার সুর ২
প্রতিবেদনটি দেখে ভেবেছিলাম জীবদ্দশায় না হোক, বহুল প্রচারিত কোনও দৈনিকে মরণোত্তর এই প্রাপ্তি তাঁর আত্মাকে শান্তি দেবে। কিন্তু সমস্ত কিছুতে জল ঢেলে দিল লেখক দেবজ্যোতি মিশ্রর কিছু অসত্য ও নাটকীয় উক্তি।
চব্বিশ-পঁচিশ বছর সময়ের মধ্যে অজয়দার বেশ কিছু রেকর্ডিংয়ে, আমি কাজ করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার কোনওটিতেই দেবজ্যোতি মিশ্রর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। লেখাটিতে ‘অজয়দার বহু ছবিতে ভায়োলিনিস্ট হিসেবে কাজ করেছি’ লাইনটি পড়ে, সেই গানগুলি জানার জন্য ফোন করেছিলাম অজয়দার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সঙ্গীত আয়োজক সমীর খাসনবিশকে। তাঁর কথায়— ‘আমার তো মনেই পড়ে না দেবু (দেবজ্যোতি মিশ্রর ডাক নাম) অজয়ের কোনও রেকর্ডিংয়ে ছিল বলে। বাজালেও কোনও একটা বা দু’টো গানে গ্রুপের মধ্যে হয়তো ছিল। তা’ও শিওর নই।”
ফোন করলাম শিল্পী অরুন্ধতী হোম চৌধুরীকে। সমীরদার কথা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে যিনি অজয়দার সুরে সব থেকে বেশি গান গেয়েছেন। তাঁর বিবৃতি, “মনেই করতে পারছি না দেবুকে অজয়দার ফ্লোরে। ওকে তো প্রথম দেখি সলিলদার কাছে!”
সঙ্গত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগে যে, সঙ্গীতকার দেবজ্যোতি মিশ্র উপরিউক্ত অনৃত ভাষণটি যদি সর্বসমক্ষে পরিবেশন না করতেন, তবে অজয় দাসের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ‘অসম্পূর্ণ’ থেকে যেত কি?
দেবজ্যোতি লিখেছেন, “যেমন শ্রীরাধা কাঁদে-র মতো তেমন করে কাউকে কাঁদতে দেখিনি শেষযাত্রায়।” ওঁকে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা, সেদিন অজয় দা’র স্ত্রী, একমাত্র কন্যা, জামাতা, পরিবারের আর সব আত্মীয় কিংবা গায়ক ইন্দ্রনীল সেন, শিবাজী চট্টোপাধ্যায় সহ সেখানে উপস্থিত সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র জগতের অন্যদের কি আপনি হাসতে দেখেছিলেন?
আপনি কোথায় ছিলেন? যখন আপনার প্রাণের সুরকার হাসপাতালের ভিতর তাঁর জীবনযুদ্ধের শেষ সংগ্রাম চালাচ্ছেন? এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে, “এই অপার উদাসীনতা কেন?”
অজয়দার স্ত্রীর কথা অনুযায়ী ওই দমবন্ধ করা দিনগুলিতে ব্যক্তিগত ব্যস্ততার ফাঁকে মাঝে মধ্যে খোঁজখবর নিয়েছেন কিছু শিল্পী, তাঁর ঘনিষ্ঠরা এবং অবশ্যই বর্তমান রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রতিনিধি। আর সে সব না জেনে আপনি মস্ত ইন্টেলেকচুয়ালের মতো লিখে ফেললেন ‘বিপন্ন চলে যাওয়া পথের
ধারে তাঁদের আর দায় নেই কোনও।’
আপনি ‘এ বেলায় তারা যেন ছায়া ছায়া মুখ’ বলে কাদের বোঝাতে চেয়েছেন, বোঝা গেল না। দিনের উজ্জ্বল আলোতেও সেখানে উপস্থিত অজয় দাসের দীর্ঘ দিনের কয়েকজন ঘনিষ্ঠদের ঠাহর করতে পারেননি দেখে অবাক হলাম! ‘বহু শিল্পীর অনুপস্থিতিতে জমে উঠল অসম্মানের মেঘ’ এই বাক্যের মধ্য দিয়ে কার্যত আপনি কি অপমান করলেন না, বাংলার বহু শিল্পী ও কলাকুশলী সহ অজস্র অজয় দাস প্রেমীদের? একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে অজয় দাস সম্বন্ধে আপনি লিখতেই পারেন। তবে আপনার লেখায় যেভাবে কিছু অসত্য এবং একান্ত ব্যক্তিগত কল্পনার জাল বিস্তৃত হয়েছে, আপনার ব্যক্তিগত প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তা না করলে আপনার কি বিশেষ কোনও ক্ষতি হত? যদিও সঙ্গীতকার হিসেবে এবং অবশ্যই একজন মানুষ হিসেবে অজয় দাস থেকে যাবেন সম্মানিত আসনে।


প্রতিবেদকের জবাব: শিল্পের চরাচরে এখন শোকের ছায়া। এই দুঃসময়ে কোনও ব্যক্তির সমালোচনার চাপানউতোর বোধহয় উচিত নয়। তবুও অজয় দাসের উদ্দেশে লিখিত আমার শ্রদ্ধা নিবেদন এক গভীর মনস্তাপের কারণ হয়েছে শ্রী শান্তনু বসুর।
আমি বেশ বুঝতে পেরেছি সন তারিখের রোজনামচায় শ্রী বসু আমার থেকে ঢের করিৎকর্মা মানুষ। কিন্তু জীবনের মুহূর্তগুলোকে আমি পঞ্জিকাবদ্ধ করে রাখিনি, রাখব না বলেই। গত তিরিশ বছর ধরে আমি ভায়োলিন বাদক হিসেবে কাজ করেছি সঙ্গীত জগতে। সঙ্গে আমার সতীর্থরা। অজয়দার সঙ্গে কাজ না করে তাঁর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প ফাঁদার মতো রুচি বা উদ্দেশ্য আমার নেই।
যে ভাবে শ্রী বসু, শ্রী সমীর খাসনবিশকে প্রশ্ন করে জেনেছেন “বাজালেও কোনও একটা বা দু’টো গানে গ্রুপের মধ্যে হয়তো ছিল।” এটি আমাকে মর্মাহত করেছে এই কারণেই যে সঙ্গীতশিল্পে যৌথতার অবদানকে তুচ্ছ মনে করছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে ‘পণ্ডিত পেয়াদা’দের বড় ভয় পেতেন। শ্রী বসু সম্ভবত তাঁদেরই একজন, যিনি অক্লেশে “‘যেমন শ্রীরাধা কাঁদে’-র মতো করে তেমন কাউকে কাঁদতে দেখিনি”- র আক্ষরিক অর্থেই ঘুরপাক খেয়েছেন। এই কান্না উত্তরসূরি সমস্ত সঙ্গীতশিল্পীর মর্মবেদনার প্রকাশ। যে প্রকাশ আমি আবারও বলব, অজয়দার মতো সুরস্রষ্টার জন্য আরও বেশি করে প্রাপ্য ছিল। ‘তেমন কাউকে’ বলতে অবশ্যই তাঁর পরিবার বা আত্মীয়প্রতিমদের আমি বোঝাতে চাইনি। সহমর্মী নেতা-নেত্রীদেরও না। বোঝাতে চেয়েছি সঙ্গীতের সঙ্গে ওতপ্রোত যুক্ত উত্তর প্রজন্মকে।
আমার এই শ্রদ্ধা নিবেদন সম্পূর্ণই পূর্বসূরি সুরস্রষ্টার প্রতি উত্তরসূরি অনুজের এক আত্মিক আবেগ। সেই আবেগকে যথাযথ ভাবে যদি কেউ অনুভব করতে না পারেন, সেটা তাঁর হয়ে আমার পক্ষেও দুভার্গ্যজনক।
পুনশ্চ: লেখা বেরোনোর পর শিল্পী জায়া আমাকে জানিয়েছিলেন- ‘‘এত দিন আমাকে যেন বিষণ্ণতার অন্ধকার ছেয়ে ছিল। আজ ওর মূল্যায়ন হচ্ছে ভেবে এই বেদনার মধ্যেও আনন্দের আলো দেখতে পাচ্ছি। আমি একটা চশমা ও লেখাটি টেবিলে রেখে দিয়েছি। হঠাৎই দুম করে দরজা খুলে এসে ও যেন পড়ে নিতে পারে।” শিল্পীকন্যা শায়রি জানিয়েছে, “এত দিনে বাবার সত্যিকারের অ্যাসেসমেন্ট করলেন দেবুদা।”
তবু বলব, লেখাটিতে অনবধানে কাউকে আঘাত করে থাকলে আমি আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.