সঙ্গীত সমালোচনা ১...
দূর আকাশে তোমার সুর
চৈত্র শেষের বিকেলে হঠাত্‌ই আলো ফুরিয়ে এলে দেখা হল না তোমার প্রিয় বৈশাখের সঙ্গে আর। সঙ্গীতকার অজয় দাসের চলে যাওয়ায় কিছু অস্বস্তিকর সত্যি মাথার ভিতর ইতস্তত কালবোশেখি মেঘ ছড়াচ্ছিল।
তোমার জন্য ভালবাসা থাক তোলা। যা পেয়েছ সত্যিই বেশি কিছু? উপেক্ষা আর আদরে ভেসে গেল ‘আদরের নৌকো’। অভিমানের আর মনখারাপ হবে না কখনও। অজয়দা চলে গেলেন। চিতাতেই সব শেষের পালা সাঙ্গ করে। যদি’বা পুনর্জন্ম ঘটে, তবে সে জন্ম হবে তাঁর কাজের। মানুষটি আপাতত নিশ্চিন্ত। এক মাসেরও বেশি পেরিয়ে গেল কিন্তু এখনও ভুলতে পারছি না তোমায়, অজয়দা।
আমাদের শহর দ্রুত পালটে গিয়েছে কখন। ফুলের মালা জমে পাহাড় ... ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে ... এমন অপূর্ব কবিতা-মুহূর্ত মৃত্যুকে ঘিরে মনে এল না আর! সুরকারের মৃত্যু আমার শহরে এতটা মহার্ঘ হয়ে উঠল না। আসলে অজয়দাকে স্মৃতির শহর বেশ কিছু কাল আগেই বিদায় জানিয়েছিল।
আশির দশকের বাংলা ছবির গান বেঁচে থাকবে অজয় দাসের অপূর্ব মেলোডিয়াস সুরের জনপ্রিয়তায়। যত সাধারণই হয়ে থাকুক সেই সব ছবি, হোক যতই নগণ্য, তাত্‌ক্ষণিক দাবি মিটিয়েও জেগে থাকে সুরের টান।
তাঁর ছবির সংখ্যা দেড়শোর ওপর। এই সুরকারের গান প্রতিদিন বেজে চলেছে এফএম, শহরতলি আর মফস্‌সলের মাইকে। তবুও মনে হয় যেন নতুন আর পুরোনো দুই প্রজন্মই এ গানগুলির মালিককে মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি।
‘এপারে থাকব আমি’, ‘আজ মিলন তিথির’, ‘আমার এ কণ্ঠ ভরে’, ‘আমি যে কে তোমার’, কী অপূর্ব সুরের মূর্ছনা! সত্যি বলতে বাংলা ছবির গানে কিশোরকুমারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন অজয় দাস। ‘দূর আকাশে তোমার সুর’ এই গানটিকে তো বাংলা ছবির সেরা কুড়িটি গানের তালিকায় রাখা যায় অনায়াসে। তবু এই অপার উদাসীনতা কেন এই মানুষটির প্রতি?
দীর্ঘ তেরো বছর আমি সলিলদার (সলিল চৌধুরী) সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। একদিন হেমন্তদার বাড়িতে কথায় কথায় অজয় দাসের প্রসঙ্গ এল। সলিলদাকে হেমন্তদা বলেছিলেন, “অজয় তোমার ঝাঁকের মাছ নয়, আবার সুধীনেরও নয়। আমার কথা ছেড়েই দাও। ও একটা নিজস্ব ঢং তৈরি করেছে। গানগুলো শুনলে বোঝা যায়, ও একেবারে নির্ঘাত অজয়।” সলিলদাও সমর্থন করেছিলেন।
অজয়দার বহু ছবির রেকর্ডিংয়ে ভায়োলিনিস্ট হিসেবে কাজ করেছি। গানের প্রিলিউড, ইন্টারলিউড নিজে তৈরি করতেন। আর কখনও ওয়াই এস মুলকি, কখনও সমীর খাসনবিশ সাজিয়ে তুলতেন গানগুলিকে। নতুন সময়ের নতুন প্রজন্মের মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে সমান আগ্রহ নিয়ে কাজ করতেন, সুযোগ দিতেন। খুব কম সঙ্গীতকারই মিউজিশিয়ানদের এতটা প্রিয় হন। সলিলদা, সুধীনদা, অভিজিত্‌দা এবং পরবর্তী কালে অজয়দা ছিলেন আমাদের খুব প্রিয় মানুষ। কারণ এঁরা শুধুমাত্র সুরকার নন। মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টও ছিল এঁদের দখলে। যে যাঁর সীমানায় দাঁড়িয়ে যত্নআত্তি করতে পারতেন তাঁদের সুরগুলিকে। কোনও দিন অন্য কোনও সুরকারের সমালোচনা করতে দেখিনি তাঁকে।
যেমন দেখেছি অজয়দাকে ... এক আত্মভোলা মানুষ। খুঁটে লেগে ছিঁড়ে গিয়েছে শখের পাঞ্জাবি। উড়োঝুড়ো চুল। খোলা হাসি। উদাত্ত গলা। একটা মুঠি মুখের কাছে ধরা। কোনও দিন রাগতে দেখিনি। সবার সঙ্গে এক সারিতে হইহই করে খাওয়ার আনন্দ আর অফুরন্ত খুশির জীবনী। ডেকে নিতেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত মিউজিশিয়ানদের, শুধুমাত্র আড্ডাটা জমাট হবে বলে।
আমার মনে হয়, এই তো সেদিন। মানুষটিকে ঘিরে কত যে উত্তেজনা, কত নতুন মুখ, কত উঠতি গায়ক-গায়িকা! তথাকথিত অ্যারেঞ্জারকে টপকে সোজাসুজি ফোন করে নেওয়া যেত তাঁকে, একটা কাজের জন্য। জুটেও যেত। তাঁরা সব কোথায়? রঙিন সেই সব মুহূর্তের ফ্রেম থেকে একে একে সরে গিয়েছে মানুষগুলো। নির্জন নিঃসঙ্গ ছবির ফ্রেমে জমেছে বিষণ্ণ বিকেলবেলা। শহর আমার দ্রুত পালটে যাচ্ছে, অজয়দা।
অজয়দার সুরে ঠিক কী ছিল? ইমোশন আর ইন্টেলিজেন্সের যুগলবন্দি। আর সচরাচর না-দেখা অপূর্ব লো নোটসের ব্যবহার। ছন্দের বুনটে আচমকা বাঁক নিতে পারত অন্তরা বা সঞ্চারী। সুরের ম্যাজিক মোমেন্ট তৈরি করার সাবলীল দক্ষতায় এই স্রষ্টা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
কিশোরকুমারের ডেট পাওয়া সেই সময়ে যখন প্রায় দুষ্কর, অজয়দা ঠিক তখনই একের পর এক গান গাইয়ে নিয়েছেন তাঁকে দিয়ে। প্রোডিউসাররা নিশ্চিন্তে থাকতেন ডেট নিয়ে কিশোরকুমার অন্তত এই সুরকারকে ঘোরাবেন না। মুম্বইতে অজয় দাসের ডেরা ছিল কিশোরকুমারের বাড়ি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অজয় দাস
আশির দশকের মাঝামাঝি মাইকের দৌরাত্ম্য যখন তুঙ্গে, এক প্যান্ডেল ছাড়িয়ে আর এক প্যান্ডেলে, এক মাইক ছাপিয়ে আর এক মাইকে বেজে চলেছে অজয়-কিশোর-লতা ... ‘আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও’। আর আশার গলায় রেডিয়ো শোনাত যখন, ‘এ মন আমার হারিয়ে যায় কোন খানে’ ... তখন ঝলমলিয়ে উঠত সবার মন। এই গানটিতেই আশার গলায় ‘আঃ-হা-হা-হা, আঃ-হা-হা-হা’ দুলুনি যেন ক্রোমাটিক ছন্দের এক উচ্ছল ঝরনা। ভাবতে অবাক লাগে অবলীলাক্রমে আমরা এমন এক অনন্য সুরকারকে ভুলেই বসেছি।
খবর হঠাত্‌ই এল, তাঁর প্রিয় বন্ধু তবলিয়া শুভেন দে’র কাছ থেকে। যিনি আমাদের প্রিয় বাঁকুদা। হরিহরআত্মা ছিলেন দু’জন। এক মনখারাপের মেঘপিওন বার বার পৌঁছতে চাইল আমার সতীর্থদের মেসেজ বক্সে ... অজয়দা নেই!
বহু ক্ষণ পরে দু-একটা ছেঁড়াখোঁড়া নেহাতই সৌজন্যের উত্তর এসেছিল। সবার হয়ে কেন জানি না, আমার এক তীব্র অনুশোচনা ও আত্মগ্লানি বোধ হল। আমরা সত্যিই পারলাম অজয়দা, তোমাকে ভুলে যেতে!
একদিন প্রিয়া সিনেমার লাগোয়া একটি গানের স্কুলের পাশে পানের দোকানে অজয়দা। ট্যাক্সিতে আমি হু হু করে এগিয়ে চলেছি। “রোককে রোককে” বলতে বলতে আরও খানিকটা দূর। দেশপ্রিয় পার্ক ঘুরে দোকানের কাছে এসে অবশেষে - “কেমন আছেন অজয়দা?”
আমার কথার ওপর সেই স্মিত হাসির আলো, “তোমার চলছে কেমন গানবাজনা? কারও জন্য নয়, নিজের জন্য গান করবে, বুঝলে,” একটু থেমে এক উদাসীন প্রশ্ন, “আমার গানগুলো থাকবে তো?” আমার উত্তরে অজয়দার মন ছিল না। বললেন, “বুঝতে পারি না আজকাল। দু-চারটে থাকলেও ভাল লাগবে, বুঝলে।” প্রশ্ন করি, “নতুন ছবিটবি কিছু করছেন?” শিশুর মতো হেসে বললেন,“আরে ধুর, প্রোডিউসার আসে না। আমারও এসব গানবাজনা আসে না, দেবু।”
অজয়দার সুরে, শ্যামল মিত্রের গলায় ‘পান্না হীরে চুনি’র সেই বিখ্যাত গান, ‘যেমন শ্রীরাধা কাঁদে’র মতো করে তেমন কাউকে কাঁদতে দেখিনি শেষযাত্রায়। বহু শিল্পীর অনুপস্থিতিতে জমে উঠল অসম্মানের মেঘ। বহু চেনা মুখ সব, যারা ভিড় করে ছিল তোমার উজ্জ্বল সেই সব দিনে, তাঁদের সঙ্গে দেখা হল না এই প্রান্তিকে। এ বেলায় তারা যেন বড় ছায়া ছায়া মুখ। বিপন্ন চলে যাওয়া পথের ধারে তাঁদের আর দায় নেই কোনও! অনেক দূরে ছেড়ে চলে আসা সেই সব নাম না-জানা স্টেশন।
না হয় বুঝলাম, তোমার জন্য আমার শহর কোনও এপিটাফ আর এলিজি লেখেনি। তবু তোমার সেই শেষ প্রশ্নের উত্তর দিই অজয়দা। আলবাত থাকবে তোমার গান। যেভাবে থাকবে জেনে পৃথিবীর যে কোনও গভীর শিল্পী নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে পারেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.