ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বাস কিনেছিল রাজ্য সরকার। চালাতে দেওয়া হয়েছিল বেসরকারি মালিকদের। কথা ছিল, ঋণের টাকা কিস্তিতে মেটাবেন তাঁরা। কিন্তু সরকার বাসের ভাড়া না বাড়ানোয় কিস্তি দিচ্ছেন না বেশির ভাগ মালিকই। তার ফলে এখন ৪০ কোটি টাকার বোঝা সরকারের উপরে। এই অবস্থায় বাসগুলি তারা নিজেরাই চালাবে, নাকি ঋণের অঙ্ক এ ভাবে বেড়েই চলবে— দু’বছর কেটে যাওয়ার পরেও সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি রাজ্য।
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ২০০৯ সালে ১৫ বছরের পুরনো বাস বসিয়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন বাম সরকার। ফলে শহর জুড়ে শুরু হয় বাসের আকাল। সঙ্কটে পড়েন যাত্রীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আর্বান রিনিউয়াল মিশন’ (জেএনএনইউআরএম) প্রকল্পের আওতায় ৫১২টি বাস কেনে রাজ্য সরকার। এক-একটি বাসের দাম পড়ে ২০ লক্ষ টাকা। বাস কিনতে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেয় সরকারই। এর মধ্যে ৪৯৬টি বাস বিভিন্ন বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিয়ে সরকার শর্ত দেয়, একটি বাসের জন্য ১০ লক্ষ টাকা দিতে হবে তাঁদের। টাকা দিতে হবে মাসিক ২২ হাজারের কিস্তিতে।
পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, “বেশির ভাগ বাসমালিকই আড়াই থেকে তিন লক্ষ টাকা দেওয়ার পরে মাসিক কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কয়েক জন পাঁচ-ছ’লক্ষ টাকা শোধ করেছেন। কিন্তু ব্যাঙ্কের থেকে যেহেতু ঋণ নিয়েছে সরকার, তাই আমাদেরই সেই টাকা শোধ করার কথা। বাস-মালিকেরা টাকা না দেওয়ায় ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। মে মাসের শেষে বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকা। জুন মাসে তা বেড়ে ৪০ কোটি ছাড়িয়েছে।” |
গত প্রায় দেড় বছর ধরে টাকা শোধ করছেন না বাসমালিকেরা। আর তখন থেকেই শুরু হয়েছে সরকারের সঙ্গে তাঁদের চাপান-উতোর। বাসমালিকদের বক্তব্য, “গত দু’বছরে জ্বালানি এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশের দাম যে হারে বেড়েছে, সেই তুলনায় বাসের ভাড়া বাড়ায়নি সরকার। প্রশাসন গোঁ ধরে বসে আছে। তার উপরে জেএনএনইউআরএম প্রকল্পের বাসগুলির মেরামতের খরচও সাধারণ বাসের তুলনায় বেশি। সব মিলিয়ে এই বাস চালিয়ে লাভ হচ্ছে না।” তাঁদের প্রশ্ন, “মাসিক কিস্তির টাকা দেব কোথা থেকে? অনেক বাস তো রাস্তায় নামছেই না।” জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেট্সের নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা টাকা শোধ করব না বলছি না। কিন্তু বাসভাড়া না বাড়ালে টাকা দেব কোথা থেকে?” ঋণ মেটাতে পরিবহণমন্ত্রীর কাছে গত সপ্তাহে জেএনএনইউআরএম-এর বাসের জন্য পৃথক ভাড়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন বাসমালিকেরা। সেই প্রস্তাবও খারিজ করে দিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। সরকার যে বাসভাড়া বাড়াতে নারাজ, তা জানান পরিবহণ-কর্তারা।
পরিবহণমন্ত্রী অবশ্য হুঁশিয়ারি দিয়েই চলেছেন। তাঁর কথায়, “বেসরকারি মালিকেরা যদি বাস না চালাতে পারেন, তা হলে সরকারকেই ওই বাসগুলি নিয়ে চালাতে হবে। তাতে টাকা শোধ করতে হলেও শহরবাসীকে অন্তত পরিষেবা দেওয়া যাবে।” এই জন্য জেএনএনইউআরএম প্রকল্পে নতুন যে সব বাস কেনা হচ্ছে, তা সরকার চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান মদনবাবু।
পরিবহণ-কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, সরকারের বাস নেওয়ার কথা আগেও বলেছেন পরিবহণমন্ত্রী। কিন্তু তা কার্যকর করতে পারেননি। কারণ, ওই বাসগুলির যা অবস্থা, তা রক্ষণাবেক্ষণ করে পথে নামাতে আরও বেশি ক্ষতি হবে সরকারের। বেসরকারি বাসমালিকেরা অবশ্য বলছেন, “সরকার বাস নিলে আমাদের আপত্তি নেই। আমরা চালাতে পারছি না। সরকার পারলে চালাক।”
|