শিল্পমহলের আপত্তির তোয়াক্কা না-করে রাজ্যে ঢোকা পণ্যের উপরে প্রবেশ-কর বসিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার, যা নিয়ে সদ্য সদ্য আদালতে তারা ধাক্কা খেয়েছে। তবে তার আগেই ব্যবসায়ীদের আর্জি মেনে কলকাতার মধ্যে যাবতীয় কৃষিপণ্য বেচাকেনায় বিপণন-কর আদায়ে দাঁড়ি টেনেছে প্রশাসন। শুধু তা-ই নয়, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে জেলায় জেলায় ফল-সব্জিতে বিপণন-কর আদায়ও স্থগিত রয়েছে। সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট প্রবেশ-করকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে নাকচ করায় এমনিতেই সরকারের রাজস্ব আদায় ভাল রকম মার খাওয়ার আশঙ্কা। কলকাতায় বিপণন-কর প্রত্যাহারের জেরে রাজস্বহানির বহর আরও বাড়বে সন্দেহ নেই।
১৯৭২ সালের ‘এগ্রিকালচারাল প্রোডিইউস মার্কেটিং ট্যাক্স অ্যাক্ট’ মোতাবেক পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোয় শ’খানেক কৃষিপণ্যে বিপণন-কর আগে থেকেই বলবৎ। পরিবর্তনের সরকার ক্ষমতায় এসে কলকাতার বিভিন্ন পাইকারি বাজারেও তা আরোপ করে। কিন্তু দু’বছর না-গড়াতেই তাতে ইতি টেনে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। সরকারের বক্তব্য: ব্যবসায়ীদের আবেদনের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত। যদিও প্রশাসনের একাংশের মতে, বিপণন-কর আদায়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব।
বস্তুত ‘স্বচ্ছতা’ নিয়ে অভিযোগের জেরেই ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে জেলার বাজারে ফল ও সব্জিতে বিপণন-কর নেওয়া বন্ধ রয়েছে। মহাকরণের খবর: বিভিন্ন সূত্রে মুখ্যমন্ত্রীর কানে এসেছিল যে, জেলার বহু বাজারে পচনশীল ফল-সব্জির ট্রাক আটকে বিপণন-করের নামে মোটা টাকা আদায় হচ্ছে, যার সিংহভাগ সরকারি কোষাগারে জমা পড়ছে না। সরকারি এক কর্তা অবশ্য বলেন, “শুধু এটাই নয়। সব্জি-ফলের দাম কিছুটা কমানোও মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্য।” কিন্তু কলকাতায় কর প্রত্যাহার হল কেন?
রাজ্যের কৃষি-বিপণন সচিব সুব্রত বিশ্বাসের ব্যাখ্যা: জেলায় বিপণন-কর বাবদ পাওয়া অর্থে বাজারকর্মীদের বেতনের সংস্থান ও পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ হয়। কলকাতায় তার বিশেষ অবকাশ নেই। পাশাপাশি কলকাতার ব্যবসায়ীদের পুরকর, ভ্যাট, প্রবেশ কর-সহ নানা কর দিতে হয়। কৃষিপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার গঠিত টাস্ক ফোর্সের ব্যবসায়ী-সদস্য রবীন্দ্রনাথ কোলের কথায়, “ব্যবসায়ীরা মুখ্যমন্ত্রীকে আর্জি জানিয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশেই সিদ্ধান্ত।” পোস্তাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহকারী সম্পাদক গৌতম গুপ্তের যুক্তি, “কলকাতায় কোনও কৃষিপণ্য উৎপন্ন হয় না। তাই এখানে ওই কর অযৌক্তিক।”
কিন্তু ঘটনা হল, সরকার যে বিজ্ঞপ্তি জারি করে এ হেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, খোদ কৃষি-বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়ই তা জানেন না! খবরটি শুনে তিনি যারপরনাই বিস্মিতও। “বাম আমলে কলকাতা শহর-এলাকায় কৃষিপণ্য কর আদায়ের দায়িত্ব ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা নিয়ন্ত্রিত বাজার কমিটির। তাতে বিস্তর কর ফাঁকি চলতো। আমরা এসে কলকাতার জন্য আলাদা নিয়ন্ত্রিত বাজার কমিটি চালু করি। তাতে ভাল ফল মিলেছে। সরকারের দু’বছরের সাফল্যের খতিয়ানেও এর প্রশংসা করা হয়েছে।” দাবি অরূপবাবুর। এবং তাঁর মন্তব্য, ‘‘এত সবের পরেও
কেন কমিটি তুলে দেওয়া হল, বুঝতে পারছি না!”
প্রসঙ্গত, ‘কলকাতা নিয়ন্ত্রিত বাজার কমিটি’ গড়া হয়েছিল ২০১১-র নভেম্বরে। এ ছাড়া রাজ্যে প্রায় ৪৫টি বাজার কমিটি আছে। তারাই কৃষিপণ্যে ১%-২% হারে বিপণন-কর আদায় করে। “প্রথম থেকেই বিভিন্ন কমিটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। বহু ক্ষেত্রে করের টাকায় বাজার উন্নয়নের প্রায় কোনও কাজ হচ্ছে না।” বলেন এক-কৃষি কর্তা। এ দিকে মহাকরণের খবর, ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে ট্যাংরা-তপসিয়ার ট্যানারিতে কাঁচা চামড়ায় বিপণন-কর আরোপের সিদ্ধান্ত থেকেও পিছিয়ে আসার চিন্তা-ভাবনা চলছে প্রশাসনে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ২% হারে কর আদায় করা হবে। কিন্তু সম্প্রতি মহাকরণে সরকারের সঙ্গে বৈঠকে ট্যানারি-মালিকেরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে ওই কর দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে এ ক্ষেত্রেও বছরে ৫০৬০ কোটি টাকা রাজস্ব হারানোর সম্ভাবনা।
|