পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছে খানাকুলের শৈলেন সিংহ, কোচবিহারের সিরাজুল হক, বাঁকুড়ার দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। রাজ্যের তিন প্রান্তের এই তিন বাসিন্দার মিল দু’টি জায়গায়। তিন জনেই তৃণমূল নেতা। আর তিন জনেই পঞ্চায়েত ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছেন।
শৈলেন, সিরাজুল, দিলীপের মতোই উদ্বেগের প্রহর কাটাচ্ছেন রাজ্যের আরও ৬২৭১ জন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়া এই সব প্রার্থীদের কেউ কেউ জয়ের শংসাপত্রও পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেই সার্টিফিকেট শেষ পর্যন্ত আদৌ কাজে আসবে কিনা, সেটাই এখন বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁরা। অনেক আশা নিয়ে বুধবার হাইকোর্টের দিকে তাকিয়েছিলেন ওই ৬২৭৪ জন। কিন্তু তাঁদের হতাশ করে পঞ্চায়েত জল গড়িয়ে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। এখন কী হবে জনে জনে এই প্রশ্ন করেও তার স্পষ্ট জবাব মেলেনি। এক এক জন এক এক রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ফলে সংশয় আরও বেড়েছে।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় যেমন বলছেন, “যাঁরা বিনা ভোটে জিতেছেন, তাঁদের বৈধতা নিয়ে তো কেউ প্রশ্ন তোলেনি। নির্বাচন কমিশন তাঁদের জয়ের শংসাপত্রও দিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্ট ভোট প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেয়নি, ফলে ভোট হচ্ছেই। এ নিয়ে আমার মনে কোনও সংশয় নেই।”
লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার তথা প্রবীণ আইনজীবী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতও অনেকটা এই রকমই। তিনি বলেন, “পঞ্চায়েত আইনে এ ব্যাপারে কী রয়েছে, তা আমার পক্ষে হঠাৎ করে বলা কঠিন। কিন্তু সাধারণ ভাবে আইনের দৃষ্টিতে যাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন, তাঁদের জয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। কারণ, তাঁদের জয় বেআইনি নয়, যদিও যথাযথ কিনা, সেই তর্ক রয়েছে। কমিশনও তাঁদের শংসাপত্র দিয়েছে। ফলে এই প্রার্থীদের পঞ্চায়েত সদস্য হওয়া ঠেকানো যাবে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।” যদিও শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দেয়, তার উপরেই সবটা নির্ভর করছে বলে সোমনাথবাবু বলে মনে করেন।
রাজ্যের পঞ্চায়েত দফতরের কর্তারা কিন্তু বলছেন, এ ব্যাপারে পঞ্চায়েত আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এক কর্তার কথায়, “এমন একটা পরিস্থিতি যে হতে পারে, সেটা হয়তো এই আইনের প্রণেতারা ভাবেননি। এ রাজ্যে এখনও পর্যন্ত যে ক’টা পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে, তার কোনওটাতেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি।”
পঞ্চায়েত কর্তাদের মতে, সুপ্রিম কোর্ট যদি চলতি ভোট প্রক্রিয়া বাতিল করে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে বলে, তা হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী প্রার্থীদের শংসাপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। আইনের স্বাভাবিক যুক্তি সে কথাই বলে। আর তারা যদি বর্তমান বিজ্ঞপ্তিটাকেই গ্রহণ করে ভোট পিছিয়ে দেয় বা দফা বাড়িয়ে দেয়, তা হলে আলাদা কথা। সে ক্ষেত্রে যখনই ভোট হোক, ওই প্রার্থীরা বিজয়ী বলে ঘোষিত হবেন, এমনটা ধরে নেওয়া যায়।
এ-হেন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের জটিলতা কাটাতে পঞ্চায়েত আইনে বদল ঘটানো দরকার
বলে মনে করছেন অনেকেই। রাজ্যের এক অবসরপ্রাপ্ত পঞ্চায়েত সচিব বলেন, “এ বারের অভিজ্ঞতা থেকে পঞ্চায়েত আইনে কিছু সংশোধন করতে হতে পারে। সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের বিষয়টি কোন ক্ষেত্রে কী হবে, তার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। না হলে মামলা মোকদ্দমায় অযথা জটিলতার সৃষ্টি হবে।” রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এক কর্তারও তা-ই অভিমত।
কিন্তু সে তো ভবিষ্যতের কথা। এখন কী হবে? খানাকুল জেলা পরিষদের ৪৩ নম্বর আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা তৃণমূল প্রার্থী শৈলেন সিংহের মন্তব্য, “যা চলছে, মনে হচ্ছে সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দেবে।” বাঁকুড়ার পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতির আসনে বিনাযুদ্ধে জেতা তৃণমূলের দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বলছেন, “নির্বাচন বানচাল করে দেওয়া হলে আমরা আদালতে যাব।” শৈলেন-দিলীপরা হতাশ হলেও আশায় বুক বাঁধছেন খানাকুলের তৃণমূল নেত্রী শিপ্রা মুখোপাধ্যায়, কোচবিহারের ফব নেতা জয়নাল মিয়াঁ, বর্ধমানের সিপিএম পঞ্চায়েত প্রধান বিপদতারণ পাত্রেরা। ওই তিন জনেরই অভিযোগ, চাপের মুখে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হয়েছে তাঁদের। সুপ্রিম কোর্ট ভোট স্থগিত করে দিলে ফের মনোনয়ন পেশের আশায় বুক বাঁধছেন তাঁরা। জয়নালের কথায়, “নির্বাচন যে ভাবে সুপ্রিম কোর্টে গড়াল তাতে নির্দিষ্ট সময় ভোট হবে বলে মনে হয় না। নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি হলে নিশ্চয়ই ফের মনোনয়ন জমা দেওয়ার সুযোগ পাব। এক বার বাধা দিয়ে ওরা সফল হয়েছে। বার বার তা হবে না। এ বার নিশ্চয়ই নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক কড়া থাকবে।”
|