কমিশন সুপ্রিম কোর্টে, ভোটের ভাগ্য অনিশ্চিতই
দীর্ঘ টানাপোড়েন এবং মামলার ফলে এমনিতেই সুতোয় ঝুলছিল পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন। এ বার রাজ্য নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি ভোটের আকাশে আরও ঘনীভূত হল সংশয়ের মেঘ?
আজ সকালে শুনানি ছিল কলকাতা হাইকোর্টে। তত ক্ষণে কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কমিশনের তরফে আইনজীবী মীনাক্ষি অরোরা শীর্ষ আদালতের বিচারপতি এ কে পট্টনায়ক ও বিচারপতি রঞ্জন গগৈর ডিভিশন বেঞ্চে এক আবেদনে জানিয়েছেন, হাইকোর্ট নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও যে বাহিনীর ব্যবস্থা রাজ্য সরকার করেছে, তা পর্যাপ্ত নয়। এই বাহিনী দিয়ে ভোট করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে ভোট পরিচালনার ক্ষমতা কার হাতে, এই প্রশ্নটিরও ফয়সালা চেয়েছেন তিনি। বস্তুত, প্রায় তিন মাস আগে এই প্রশ্নেই মামলা শুরু হয়েছিল হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে। সেই মামলায় বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার জানিয়েছিলেন, ভোট পরিচালনার যাবতীয় ক্ষমতা সংবিধানগত ভাবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের হাতেই। আপিল মামলায় প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ এই মূল বিষয়টি এড়িয়ে যায় (পরে অবশ্য বেঞ্চ জানায়, কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত)।
এ দিন শীর্ষ আদালতের কাছে আবেদনে এই বিষয়টিরও নিষ্পত্তি চেয়ে কমিশন বলেছে, হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গল বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ পাশে সরিয়ে রেখে তার নির্দেশিকায় বদল করেছিল। কিন্তু এই দু’টো বিষয়কে আলাদা করা যায় না। কমিশনের আবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধানের ২৪৩কে অনুচ্ছেদের বাধ্যবাধকতা মেনে রাজ্য সরকারকে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ পালন ও তা কার্যকর করতে বলা হোক।
আইন বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, যে হেতু এই সাংবিধানিক প্রশ্নে মামলাটি হচ্ছে, তাই এর গুরুত্ব অসীম। মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবের মতে, “২০০৬ সালে কৃষ্ণ সিংহ তোমর বনাম আমদাবাদ পুরসভার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠা করেছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সেই প্রাধান্যই বজায় থাকবে কি না এবং তা সমস্ত রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেই কার্যকর হবে কি না, এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের থেকে তার নতুন দিশা মিলতে পারে বলে আমার ধারণা।”
আজ কলকাতা হাইকোর্টে শুনানি শুরুর সময়েই শীর্ষ আদালতে আবেদন করে কমিশন। এর মধ্যে প্রথম দফার শুনানিতে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ জেলাবিন্যাসে হেরফের করে বাহিনীর চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ফারাক কী ভাবে কমিয়ে আনা যায়, সেটা দেখতে বলে কমিশনকে। কলকাতার এই শুনানি শেষ হতে হতেই দিল্লি থেকে খবর আসে, সুপ্রিম কোর্ট দুপুর দু’টোয় শুনানির সময় দিয়েছে। কলকাতায় বেলা ১২টায় ফের শুনানি শুরু হলে তা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চকে জানান কমিশনের আইনজীবী সমরাদিত্য পাল। তার পরে কমিশন এবং রাজ্য সরকারের হাইকোর্টের মধ্যে বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায়। যা দেখে প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র বলেন, “সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা যাওয়ায় ভালই হল। আমরা এই মামলা নিয়ে তিতিবিরক্ত।”
অন্য দিকে, দুপুর দু’টোয় সুপ্রিম কোর্টে শুনানি শুরু হলে রাজ্য নির্বাচন কমিশন জানায়, রাজ্য সরকার কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশমতো প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত ভোট পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তখন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে নোটিস জারি করে শীর্ষ আদালত। দুই সরকারের কাছে সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন, তারা কী ভাবে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় বাহিনীর চাহিদা পূরণ করতে চাইছে? শুক্রবার, ২৮ জুন পরবর্তী শুনানিতে দু’পক্ষের বক্তব্য শোনা হবে।
অতঃকিম
আইনজীবীমহল মনে করে কমিশন মনে করে
• সুপ্রিম কোর্ট ভোট স্থগিত করে দিতে পারে
• নতুন করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে বলতে পারে
• নতুন বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে দফা, তারিখ বদল করাতে পারে
• নিষ্পত্তির জন্য মামলা ফেরত পাঠাতে পারে হাইকোর্টে
• শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট যা-ই বলুক, ২ জুলাই ভোট হচ্ছে না
• প্রথম পর্ব না হলেও বাদবাকি পর্বের ভোট নিয়ে সমস্যা নেই
• কারণ, প্রতিটি পর্বের জন্য আলাদা করে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে
• সে ক্ষেত্রে শুধু প্রথম পর্বের জন্য নতুন বিজ্ঞপ্তি দিলেই হবে
• এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যা নির্দেশ দেবে সেটাই মানতে হবে

সুব্রত মুখোপাধ্যায়,

শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট ভোট করতে
বললেও ভোট করা যাবে।
মীরা পাণ্ডে,

ভোট হবেই। হয়তো দিনক্ষণ
এ-দিক ও-দিক হতে পারে।

ধন্দ যেখানে
নতুন বিজ্ঞপ্তি হলে সব প্রাথীকেই ফের মনোনয়ন জমা দিতে হবে
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা প্রার্থীদের কী হবে, তা নিয়ে সংশয়
কারও নির্বাচন বাতিল হলে সেই প্রার্থী আদালতে যেতে পারেন
সে ক্ষেত্রে নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে
আইনজীবী মহলের অনেকেই মনে করছেন, আগামী শুনানির দিন সুপ্রিম কোর্ট কী বলছে, তার উপরেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভাগ্য নির্ভর করছে। কিন্তু ওই শুনানি আর ২ জুলাইয়ের প্রথম দফার ভোটগ্রহণের মধ্যে মাত্র চার দিনের ফারাক। কাজেই সুপ্রিম কোর্ট যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, অন্তত প্রথম দফার ভোটগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে অবশ্য বলেছেন, “ভোট হবেই। দিনক্ষণ হয়তো এ-দিক ও-দিক হতে পারে।” অন্য দিকে, রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট ভোট করতে বললেও ভোট করা যাবে।”
সুব্রতবাবু কলকাতায় যে কথা বলেছেন, সেই একই সওয়াল সুপ্রিম কোর্টেও করেছে রাজ্য সরকার। কমিশনের আবেদন শোনার পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এ কে পট্টনায়ক ও বিচারপতি রঞ্জন গগৈর ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চায়, “আপনারা নির্বাচন চান, না চান না?” জবাবে রাজ্যের আইনজীবী অমরেন্দ্র সরন জানান, রাজ্য সরকার যে কোনও মূল্যে ভোট চায়। পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং কলকাতা হাইকোর্টে যে এ বিষয়ে মামলা চলছে, সে কথাও জানানো হয় রাজ্যের তরফে। বিচারপতি পট্টনায়ক তখন বলেন, “আমরা জানি ওখানে কী চলছে।” রাজনৈতিক ভাবে যার ব্যাখ্যা, বিচারপতিরা আসলে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েই কটাক্ষ করেছেন। রাজ্যের আইনজীবী মহলের পাল্টা ব্যাখ্যা, আসলে হাইকোর্টের মামলার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
শুনানির পরে রাজ্য সরকারের আইনজীবী অভিজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা কেউই চাই না যে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাক। নির্বাচন কমিশনের তরফেও বলা হয়েছে যে ভোটের নিরাপত্তার দিকটিই একমাত্র উদ্বেগের বিষয়।” মহাকরণ সূত্রের খবর, মামলা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে বৃহস্পতিবার দিল্লি যাচ্ছেন আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, পঞ্চায়েত সচিব সৌরভ দাস। সঙ্গে যাচ্ছেন সরকার পক্ষের আইনজীবী অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের সচিব নীরজ নয়ন পাণ্ডে-সহ সরকারি অফিসার ও আইনজীবীদের একটি দল।
আদালতনামা
১ এপ্রিল ’১৩ ভোট পরিচালনায় অধিকার চেয়ে হাইকোর্টে কমিশন
১০ মে হাইকোর্ট জানাল, ভোট পরিচালনার দায়িত্ব কমিশনেরই
১৩ মে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে আপিল রাজ্যের
১৪ মে • সিঙ্গল বেঞ্চের রায় খারিজ করল ডিভিশন বেঞ্চ
• পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে নয়া নির্দেশিকা হাইকোর্টের
• তারা বলল, উভয় পক্ষের সম্মতিতেই নির্দেশ
• কমিশন বলল, তাদের সম্মতিতে নির্দেশ হয়নি
১৭ মে ‘উভয়ের সম্মতি’ শব্দবন্ধ প্রত্যাহারের দাবিতে আপিল কমিশনের
১৪ জুন কমিশনই শেষ কথা, জানাল ডিভিশন বেঞ্চ
১৮ জুন বাহিনী না পেয়ে ফের ডিভিশন বেঞ্চে কমিশন
২৫ জুন হাইকোর্ট জানাল, ২৬ জুন তারা চূড়ান্ত নির্দেশ দেবে
২৬ জুন • সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছি, হাইকোর্টকে কমিশন
• ২৮ জুন ফের শুনানি
কলকাতা হাইকোর্টে মামলা চলার মধ্যেই যে রাজ্য নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টে আসতে পারে, গত সপ্তাহেই তার ইঙ্গিত মিলেছিল। গত শুক্রবার মীরাদেবী দিল্লিতে এসে আইনজীবী মীনাক্ষি অরোরার সঙ্গে বৈঠক করেন। এ দিন সকালে শীর্ষ আদালতে আবেদন তারই ফল বলে মনে করা হচ্ছে।
কোথায় সমস্যা বলে মনে করছে কমিশন? কমিশনের আইনজীবী যুক্তি দিয়েছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলস্তরে ভোটগ্রহণ হয় বলে এবং স্থানীয় সমস্যা জড়িত থাকার ফলে বিধানসভা বা লোকসভা ভোটের থেকেও এখানে হিংসার আশঙ্কা বেশি। বিধানসভায় যেখানে ২৯৪টি আসনে ভোট হয়। পঞ্চায়েতের আসন সংখ্যা ৫৮ হাজার ৮৬৫। প্রার্থীর সংখ্যা লক্ষাধিক। ৪ কোটি ৪৪ লক্ষের বেশি ভোটার। ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের সংখ্যা
৫৭ হাজারের বেশি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কমিশনের ব্যাখ্যা, গত বিধানসভা ভোটে ৬৬০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগ হয়েছিল। সেই হিসেবে এ বার তিন দফা ভোটের জন্য ৮০০ কোম্পানি বাহিনী বা মোট ২ লক্ষ ৪১ হাজার ৭৬০ জন নিরাপত্তা কর্মী প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন, রাজ্য কত বাহিনী দিতে পারবে? রাজ্য জানিয়েছে, তাদের হাতে হোম গার্ড ও এনভিএফ (ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার ফোর্স) মিলিয়ে ৫৫ হাজার ৫৮৮ জন নিরাপত্তা কর্মী রয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যেও কত জনকে ভোটের জন্য নিয়োগ করা হবে, তা-ও জানায়নি রাজ্য। এই পুরো বাহিনী নামালেও ঘাটতি থাকে আরও ৯৩ হাজার ৯৮৪ জন কর্মীর। একই সঙ্গে প্রথম দফায় ন’টি জনবহুল জেলা এবং পরের দু’টি দফা মিলিয়ে আটটি জেলা রেখে যে বিন্যাস রাজ্য করেছে, তাই নিয়েও আপত্তি তুলেছে কমিশন।
এই পরিস্থিতিতে ভোটের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে সব স্তরেই প্রশ্ন উঠেছে। রাজ্য সরকারের একটি মহলের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু ভোট প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ দেয়নি। তাই এ দিনও পোস্টাল ব্যালটে ভোটগ্রহণ চলেছে। রাজ্য সরকার সূত্রের খবর, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট যদি তিন ভেঙে দফা আরও বাড়ায়, তাতে রাজ্যের আপত্তি নেই।
কিন্তু এ বিষয়ে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে কি না, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের কী হবে, মঙ্গলবারই যে সব পঞ্চায়েতের মেয়াদ শেষ হবে সেখানে কী হবে, তা-ও খতিয়ে দেখার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে অনুরোধ করা হবে। অর্থাৎ, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট যদি রায় দেয়ও, তার পরেও জটিলতা পুরোপুরি কাটবে কি না সন্দেহ।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.