শোকতপ্ত খোরজুনায় অরন্ধন
প্রতিবাদের কোনও রং হয় না। রান্নাবান্না, ছেলেপুলেদের দেখভাল, ঘর গৃহস্থালির আর পাঁচটা কাজসব ফেলে আসা খোরজুনার মহিলাদের মিছিলেও কোনও রং ছিল না।
বুধবার সারাটা দিন গ্রামের বট তলা থেকে রাস্তা জুড়ে পথ অবরোধ, চড়া রোদ্দুরে গ্রামের এ মাথা ও মাথা টান টান মিছিল কিংবা বটচতলার সভা। সর্বত্রই ছিল গ্রামের আটপৌরে মহিলাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আর স্বাবাবিক তাতে কোনও রং ছিল না। সেই মিছিলে ছিল না স্থানীয় কংগ্রেস-সিপিএমের নেতাকর্মীদের ভিড়ও। গ্রামের মহিলারা সমস্বরে বলছেন, “আমরা লাল-সবুজে নেই। গ্রামের মেয়েদের ইজ্জত বাঁচাতে আছি।” সেই সব গ্রামীণ মুখ চোখে পড়েনি সন্ধের তৃণমূলের মোমবাতি মিছিলেও।
রবিবার ওই মহিলার দেহ মেলার পরে গ্রামেরই এক যুবককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার আগে, ওই দিন বিকেলের দিকে জেলা পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর আচমকাই ‘ঘোষণা’ করে দেন, ধর্ষণ নয়, ঘটনাটি নিছকই খুনের। সেই সঙ্গে তাঁর দাবি ছিল, পুলিশি জেরায় ধৃত প্রকাশ দাস জানিয়েছে, ওই মহিলার সঙ্গে তার ‘পুরনো সম্পর্ক’ ছিল। হুমায়ুন জানান, ধৃতের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে ওই মহিলা স্বেচ্ছায় ওই যুবকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। পুলিশ সুপারের কার্যত ‘সহবাসের’ এই তত্ত্বে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন গ্রামবাসীরা। প্রতিবাদে বুধবার বন্ধ ডাকে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট।
প্রতিবাদ দিকে দিকে। কৃষ্ণনগরে রাজ্য সড়ক অবরোধ ও খোরজুনায়
সুদীপ ভট্টাচার্য ও গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

গ্রামের বাসিন্দাদের ক্ষোভও একানেই। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার আগেই এসপি কী করে এমন ‘তত্ত্ব’ খাড়া করেন? প্রশ্ন তাঁদের।
এ দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনটি মিছিল করেন গ্রামের মহিলারা। মিছিলে স্লোগান ওঠেগ্রামে এসে জেলা পুলিশ সুপারকে ক্ষমা চাইতে হবে। মূল অভিযুক্ত প্রকাশ দাসের চরম শাস্তিরও দাবি তোলেন তাঁরা। মিছিলে পা মেলান গ্রামের আড়াইশো মহিলা।
খোরজুনার ছবি কুণ্ডুর বিয়ে হয়েছে রামপুরহাটে। ঘটনার খবর পেয়ে তিনিও গ্রামে হাজির হন। মিছিলে তিনিও পা মেলালেন। তিনি বলেন, “ওই বৌদির সঙ্গে আমার গত ১৩ বছরের সম্পর্ক। স্বভাব-চরিত্র নিয়ে আমি কোনও কিছু বুঝতে পারলাম না আর পুলিশ সুপার এক দিন গ্রামে এসে বৌদির চরিত্র জেনে গেলেন! চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করা জন্য গ্রামে এসে তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে।”
মিছিল নিয়ে যখন গ্রামের মহিলাদের ব্যস্ততা চরমে। তখন ঘরের মধ্যে সকাল থেকে এক টানা কেঁদেই চলেছে সদ্য মা হারানো ৮ বছরের মেয়ে। “মা কোথায় বল না!” তার টানা বায়নায় পাশে বসে কেঁদে চলেছেন পড়শিরা। তা দেকে বাচ্চাটার কান্নার রোল বেড়ে ওঠে। কয়েক বছরের বড় তার দাদা অবশ্য পাড়ায় সহপাঠীদের সঙ্গে তখন খেলায় ব্যস্ত ছিল পাশের মাঠে। খেলা ফেলে বাড়িতে ফিরে ভুল করে রান্না ঘরের পাশে গিয়ে খাবারের জন্য মাকে বুঝি ডেকেও ফেলেছিল সে। তারপরেই বোনকে কাঁদতে দেকে চোখের জল ধরে রাখতে পারে না ছেলেটিও।
তাকে সামাল দিতে ছুটে আসে পাড়ার পিসি-কাকিমারা। সদ্য মা-হারা ওই দুই ছেলেমেয়ের করুণ দশা দেখে বুক ফাটছে গ্রামের মালবিকা দে, বৈশাখী দাস, সাকিনা বেওয়াদের।
খোরজুনায় মিছিল। —নিজস্ব চিত্র।
বাড়ির উঠোন নিকানো, পুজো, হেঁসেলের কথা ভুলে এ দিন সকাল থেকেই গ্রামের মহিলারা জোট বাঁধেন মিছিলের। ওই ঘটনার পর থেকেই গ্রামে প্রায় অরন্ধন চলছে। মালবিকাদেবী বলেন, “রান্নাবান্না করব কি? ওই ছেলেমেয়ের মুখ দখে রান্না-খাওয়া উঠে গিয়েছে।” গ্রামের অধিকাংশ মহিলাই বাড়িতে কোনওরকমে আলু সেদ্ধ আর ভাত করেই রান্না পর্ব সারছেন।
বাড়ির মহিলাদের ওই আন্দোলনে সায় রয়েছে কৃষিজীবী বেণিমাধব দে, প্রভাত দাসদের। তাঁদের কথায়, “বোরো চাষে ক্ষতি হয়েছে। এখন আমনের মরসুম। এর মধ্যে গ্রামে বড় বিপর্যয় ঘটে গেল। ফলে চাষের কাজে মন দিতে পারছি না। বাড়ির মহিলাদের ওই আন্দোলনে আমাদের কোনও আপত্তি নেই।”
ওই মহিলার দেওর বলেন, “সংসারের জন্য বৌদি অক্নান্ত পরিশম করতেন। দাদা বইয়ের ব্যবসা করতেন। তাই সংসারের সমস্ত কাজ একাই সামলাত বৌদি। সংসার সামলানোর ফাঁকে কাপড়ে ফুল তোলার কাজ করতেন বৌদি। সেই টাকা প্রতি মাসে ব্যাঙ্কে জমা রাখতেন।”
অন্য এক দেওর বলেন, “এত বড় ঘটনা। কিন্তু কোনও বুদ্ধিজীবীকে আমাদের গ্রামে আসতে দেখলাম না। মুখ্যমন্ত্রীও নীরব! মুখ্যমন্ত্রীর উচিত ছিল আমাদের এখানে আসা। কিন্তু ভয়ও করছে। কামদুনির আন্দোলনকারীদের মত আমাদের গ্রামের মহিলাদেরও য দি তিনি মাওবাদী বলে আখ্যা দেন!”

পুরনো খবর:
এই সংক্রান্ত অন্য খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.