পঞ্চায়েত ভোটের জন্য আধা-সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন আছে কি নেই, তা রাজ্য সরকারই ঠিক করবে বলে জানিয়ে দিল কেন্দ্রীয় সরকার। গত কাল রাজ্যের মুখ্যসচিবকে পাঠানো চিঠিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব লিখেছেন, পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনার ব্যাপারে কেন্দ্রের কোনও ভূমিকা থাকে না। সেই ভোটে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার রাজ্য সরকারেরই। পাশাপাশি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্মীবর্গ বিভাগের অধিকর্তা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবকে পাঠানো একটি পৃথক চিঠিতে পঞ্চায়েত ভোট করানোর ব্যাপারে রাজ্যের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনিও জানিয়ে দিয়েছেন, সেই ভোটের নিরাপত্তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে বলেন, “এটা কোনও রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্য সরকারের আপত্তি থাকলে কেন্দ্র কখনওই আধা সামরিক বাহিনী পাঠায় না। রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া আমাদের লক্ষ্য নয়।” |
রাজ্য সরকার অবশ্য পঞ্চায়েত ভোটের জন্য ৩০০ কোম্পানি আধা সামরিক বাহিনী চেয়ে আগেই কেন্দ্রকে চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠির উত্তরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, বাহিনী পাঠানোর মতো অবস্থায় তারা নেই। এর পর বাহিনী চেয়ে ফের চিঠি দেয় রাজ্য। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গত কাল পাঠানো চিঠিতে আবারও জানিয়ে দিয়েছে, কেন্দ্রের হাতে এই মুহূর্তে যথেষ্ট বাহিনী নেই। ফলে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আধাসেনা পাঠানো সম্ভব হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্মীবর্গ বিভাগের অধিকর্তা তাঁর চিঠিতে বলেছেন, রাজ্যে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু কোম্পানি কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী রয়েছে (জঙ্গলমহল ও পাহাড়ে মোতায়েন)। এ ছাড়া, রাজ্যের নিজস্ব আধা সামরিক বাহিনী রয়েছে ২০ কোম্পানি। নিরাপত্তা রক্ষীদের দু’টি বিশেষ বাহিনীও তৈরি করেছে রাজ্য। এই সব বাহিনীকে ভোটের কাজে লাগানো যেতে পারে।
পঞ্চায়েত ভোটে আধা সামরিক বাহিনী নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে কেন্দ্রের তরফে এই প্রথম এত খোলাখুলি পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হল। রাজ্য সরকারের মতে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিঠি আদতে তাদের যুক্তিকেই প্রতিষ্ঠা করেছে। আজ কলকাতা হাইকোর্টে পঞ্চায়েত ভোট সংক্রান্ত মামলায় কেন্দ্রের পাঠানো চিঠিগুলি জমা দিয়েছে রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এর আগে রাজ্যে অন্তত দু’টি পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে, যখন মাওবাদী সমস্যা ছিল তুঙ্গে। তখন কেন্দ্র আধা সামরিক বাহিনী পাঠায়নি। আর আজ রাজ্যের পরিস্থিতি যখন শান্ত, আমরা যখন মনে করছি যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব, তখন জোর করে আধা সামরিক বাহিনী পাঠানোর চেষ্টাটা অগণতান্ত্রিক এবং রাজ্যের স্বাধিকারের উপরে কুঠারাঘাত হতো।”
রাজ্য নির্বাচন কমিশন কিন্তু পর্যাপ্ত বাহিনী না-পাওয়া গেলে ভোট করা যাবে না, এই বক্তব্যে অনড়। আজও হাইকোর্টে সে কথা বলেছে তারা। কত দফায় ভোট করলে কত বাহিনী প্রয়োজন হবে, সেই হিসেবনিকেষ আজ শেষ হয়নি। আগামিকাল সেইহিসেব জানার পরে পঞ্চায়েত ভোট আদৌ হবে কিনা, সে ব্যাপারে রায় দেবে হাইকোর্ট।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য আজ বলেন, “আমরা চাইছি পঞ্চায়েত নির্বাচন হোক। এক লক্ষের বেশি প্রার্থী ইতিমধ্যেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মানুষের রায় দেওয়ার অধিকার কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন হয়নি যে, ভোট করার জন্য আধা সামরিক বাহিনীর দরকার। মাওবাদী অনুপ্রবেশ রুখতে প্রতিবেশী রাজ্যের সীমানা সিল করার জন্য আমরা আধা সামরিক বাহিনী চেয়েছি। কেন্দ্র সেই বাহিনীও দিতে পারেনি।” |
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্র বলছে, আসলে আধা সামরিক বাহিনীর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আরও বাহিনী তৈরি করার জন্য অর্থ মন্ত্রকের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কারণ, এর সঙ্গে আর্থিক দায়ের বিষয়টি জড়িত। কিন্তু অর্থ মন্ত্রকেরও নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। ফলে সেই লালকৃষ্ণ আডবাণীর আমল থেকেই এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রকের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে।
কেন্দ্র যখন আধা সামরিক বাহিনী পাঠানোর প্রশ্নে হাত গুটিয়ে নিয়েছে, তখন মমতার অভিযোগ, নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে বিরোধীরা পঞ্চায়েত ভোটটাই বন্ধ করে দিতে চাইছে। তিনি বলেন, “প্রথমে আমি চেয়েছিলাম, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেই পঞ্চায়েত ভোট হয়ে যাক। তখন অতটা গরমও হতো না। কিন্তু তখন বিরোধীরা আগাম নির্বাচনে রাজি হল না। পরে যখন নির্বাচনের দিন ক্ষণ ঠিক হল, তখন আধা সামরিক বাহিনীর বিষয় তুলে ভোটটা বানচাল করার চেষ্টা করছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্য ইতিমধ্যেই অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখন ভোট না হলে সেই অপচয়ের জন্য কে দায়ী হবে! মানুষ কিন্তু তার জবাব চাইবে। তাই আদালত যখন ভোটটা যাতে হয় সে জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে, তখন আমাদেরও উচিত মীমাংসা খোঁজার চেষ্টা করা।”
ঘটনা হল, বাম আমলে আধা সামরিক বাহিনীর দাবিতে সরব হয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা। তাঁর যুক্তি, সে সময় কেশপুর, গড়বেতা থেকে ছোট আঙাড়িয়া একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনায় রাজ্য উত্তাল ছিল। তবে তখনও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের বিরোধিতা করেছিল শাসক সিপিএম। এবং এ যাবৎ কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়াই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট হয়ে এসেছে।
|