আমরি-কাণ্ডের পর এসএসকেএমে এক দিনে পর পর ৮০টি মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করে সকলকে অবাক করে দিয়েছিলেন এক চিকিৎসক। হাসপাতালে তখন ঠায় বসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কাকদ্বীপে নৌকাডুবির পরের ১৯ ঘণ্টায় ৮৯টি দেহের ময়নাতদন্ত করে তারিফ কুড়িয়েছিলেন আর এক জন। ডায়মন্ডহারবারে বিষমদকাণ্ডের মৃত্যুর পরেও রাতারাতি হয়ে গিয়েছিল ১২০টি দেহের ময়নাতদন্ত এবং তার রিপোর্ট।
এমন নজির রয়েছে এ রাজ্যেই। বিশেষ বিশেষ ঘটনায় প্রশাসনের নির্দেশে এমন ঝড়ের গতিতেই হয়ে যায় ময়নাতদন্ত। ঝটিতি তৈরি হয়ে যায় তার রিপোর্টও। কিন্তু প্রদীপের উল্টো দিকেই অন্ধকার। প্রচারের আলোয় আসা এই সব ‘বিশেষ’ ঘটনার আড়ালে চাপা পড়ে থাকে হাজারে হাজারে জলে ডোবা, সাপে কাটা, আগুনে পোড়া বা পথ দুর্ঘটনায় মৃতদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট। শুধু এই রিপোর্টের অভাবেই মৃতের পরিজনরা কখনও অফিসের পাওনা-গণ্ডা পান না, কখনও বা বিমার টাকা হাতছাড়া হয়, কখনও পিছিয়ে যায় বিচারের প্রক্রিয়াও।
শুধু তাই নয়, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অতি দ্রুত জমা পড়লেও তা আদৌ নিয়ম মেনে তৈরিই হয়নি। তা দিয়ে কোনও কাজই হয় না। এতে ভোগান্তি আরও বাড়ে মৃতের পরিজনদের।
এই পরিস্থিতিতে তিন দিনের মধ্যে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেশ করার ব্যাপারে হাইকোর্টের নির্দেশ রাজ্য জুড়েই শোরগোল ফেলে দিয়েছে। গোটা রাজ্যে যত ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বাকি পড়ে রয়েছে, আপাতত তা শেষ করতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে চিকিৎসকদের। ঘন ঘন স্বাস্থ্য ভবন থেকে তাগাদা আসছে। কাজ ঠিকঠাক হল কি না, তা তিন মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারকে হাইকোর্টের কাছে জানাতে হবে। এত দ্রুত ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কী করে দেওয়া হবে, তা নিয়ে চিন্তিত প্রশাসনের কর্তারা।
কেন দেরি হয় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দিতে? কলকাতা ও জেলার ফরেন্সিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই জানিয়েছেন, ডাক্তারের অভাব তো রয়েছেই, কোথাও কোথাও আবার ময়নাতদন্তের জন্য একটা টেবিলও মেলে না। শীতাতপনিয়ন্ত্রণের যন্ত্র অকেজো বহু জায়গায়। স্টেনোগ্রাফার পদ রয়ে গিয়েছে কাগজে-কলমেই। যে চিকিৎসক কাটাছেঁড়া করছেন, তিনিই নোট নিচ্ছেন, তিনিই আবার পরে তা লিখছেন। বিশেষ মতামতের জায়গাটিতে প্রয়োজনে তাঁকেই আবার টাইপ করতে হচ্ছে। আদালতে নিত্য হাজিরাও দিতে হচ্ছে তাঁকেই। একই সঙ্গে এত চাপের মুখে পড়ে তিনি কোনওটাই ঠিকঠাক করে উঠতে পারছেন না।
এসএসকেএম হাসপাতালের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিৎসক বিশ্বনাথ কাহালি বলেন, “এত কাজের চাপ থাকলে রিপোর্ট বকেয়া হতে বাধ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক একটা কেন্দ্রে সপ্তাহে তিন-চারটি করে ময়নাতদন্ত হয়। আর এখানে মোমিনপুর মর্গে বছরে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার দেহ আসে। ডাক্তার মাত্র তিন জন।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, গত জানুয়ারিতে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা ময়নাতদন্তের ‘প্রিন্টেড রিপোর্ট’ দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু তার পরেও সেই নিয়ম কার্যত কোথাও মানা হচ্ছে না। কেন? এসএসকেএমের এক চিকিৎসক বলেন, “আমরা কম্পিউটারের ব্যাপারে অত কিছু বুঝি না। তাই সরকারকে তো আগে কম্পিউটার এবং ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের ব্যবস্থা করতে হবে।” নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসকের কথায়, “সব জায়গায় তো কম্পিউটারই নেই। আবার কম্পিউটার থাকলেও সেগুলো ঠিকঠাক চলে না। অত বড় ফর্মের প্রিন্ট আউট বেরনোর মতো বড় প্রিন্টারও সরকারি হাসপাতালে নেই।”
ময়নাতদন্তের জন্য চিকিৎসক নিয়োগের কথা স্বরাষ্ট্র দফতরের। কিন্তু বাস্তবে স্বাস্থ্য দফতরের নিযুক্ত ডাক্তাররাই ময়নাতদন্তের কাজ চালাচ্ছেন। কিন্তু সংখ্যায় তাঁরা নেহাৎই নগণ্য। স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, রাজ্যে ফরেন্সিক মেডিসিন-এর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের যথেষ্ট অভাব। মোমিনপুর মর্গের ময়নাতদন্তকারী তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনার মেডিকো-লিগ্যাল বিভাগের উপ মুখ্য স্বাস্থ্যঅধিকর্তা উমাপ্রসন্ন ঘোষাল বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে খুন অথবা ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় ময়নাতদন্ত করাটা জটিল হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে মৃতদেহের প্রতিটি অঙ্গের খুঁটিনাটি পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনে একাধিক বারও ময়নাতদন্ত করতে হয়। সে ক্ষেত্রে তদন্তকারী অফিসাররাও রিপোর্ট দেরিতে পান।”
আর এ ভাবে একটি দেহের একাধিক বার ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে অন্যান্য অস্বাভাবিক মৃত্যুর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পিছিয়ে যায় বলে ময়নাতদন্তের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকদের দাবি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দ্রুত কী করে তৈরি করা যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। উমাপ্রসন্নবাবু জানান, কল্যাণী সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক গৌতম চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক জে কে মণ্ডল এবং দুই ছাত্র তীর্থঙ্কর কাঞ্জিলাল ও রোহিত প্রসাদের সহযোগিতায় তিনি একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছেন, যার নাম ‘মর্গ সফটওয়্যার প্যানেল’। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ময়নাতদন্তের রিপোর্টের ফর্ম যদি ওই সফটওয়্যারে রাখা থাকে, তা হলে ময়নাতদন্ত করার পরেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অথবা এক জন অপারেটর ওই ফর্মে তথ্যগুলি পূরণ করবেন। তার পরে চিকিৎসক নিজে বিশেষ মতামতের জায়গাটিতে নিজের বক্তব্য জানাবেন। এর পরে দ্রুত তা অনলাইনে চলে যাবে। নাম, পুলিশ স্টেশন ও কেস নম্বর উল্লেখ করে খোঁজ করলেই ওই সফটওয়্যারের মাধ্যমে তা তদন্তকারীরা দেখতে পাবেন। প্রয়োজনে সফটওয়্যার লিঙ্ক থেকে ওই রিপোর্ট ডাউনলোড করে নিয়ে তদন্তের কাজ করতে পারবে পুলিশ। পরে প্রশাসনের কাছ থেকে লিখিত আবেদন করে ময়নাতদন্ত রিপোর্টের মূল কপি সংগ্রহ করবেন মৃতের পরিজন ও পুলিশ।
এটি অনেক সুবিধাজনক হবে বলে মনে করছেন আইনজীবীরাও। আইনজীবী কল্লোল মণ্ডল বলেন, “অনলাইন ব্যবস্থা চালু হলে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পরে আর প্রভাবিত করার কোনও সুযোগ থাকবে না। হাতে লেখা রিপোর্টের ক্ষেত্রে সেই অভিযোগ প্রায়শই ওঠে। হাইকোর্টে ক্ষেত্রেও যেমন রায় দানের পরেই তা আপলোড করে দেওয়া হয়, এ ক্ষেত্রেও তেমন ব্যবস্থা চালু হওয়াই বাঞ্ছনীয়।”
কিন্তু এতে সাধারণ মানুষের হয়রানি কতটা কমবে? কারণ, দীর্ঘসূত্রতার পিছনে সরকারি লাল ফিতের ফাঁসও তো খানিকটা দায়ী। নিয়ম অনুযায়ী মৃতের পরিজনরা চার সপ্তাহের আগে রিপোর্ট হাতে পান না। জেলায় পুলিশ সুপার ও শহরাঞ্চলে কমিশনার কাছে রিপোর্টের জন্য আবেদন করতে হয়। কিন্তু সেই ফাইল নড়তেই মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়। দীর্ঘ হয় অপেক্ষায় থাকা মানুষের তালিকা।
হাইকোর্টের রায় এই লাল ফিতের ফাঁসকেও খানিকটা আলগা করতে পারে কি না, সেটাও দেখার।
|
ময়নাতদন্ত কী |
• মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করে মৃত্যুর কারণ, সময়, ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা কত ধরনের ময়নাতদন্ত
• মেডিকো-লিগ্যাল (অস্বাভাবিক যে কোনও মৃত্যুর জন্য)
• প্যাথোলজিক্যাল (শুধুমাত্র রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনে) রিপোর্ট কী কাজে লাগে
• পুলিশের ক্ষেত্রে তদন্তের স্বার্থে
• তদন্ত সঠিক কি না তা আদালতে যাচাইয়ের জন্য
• বিমা ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসাবে |
|