রবিবারের বৃষ্টির দুপুর। কাদা মাঠ, ঘরের গলিপথ ডিঙিয়ে এসেছেন সুটিয়ার মেয়েরা। মিটিং হবে। ৫ জুলাই সুটিয়ার বরুণ বিশ্বাসের মৃত্যুবার্ষিকীতে কী কর্মসূচি নেওয়া যায়, তারই সিদ্ধান্ত হবে সেখানে। জনা তিরিশেক মেয়ে। ছোট্ট মাটির রোয়াকে বসে হাতপাখা চালাতে চালাতে কথা বলছিলেন ওঁরা। রক্তদান শিবিরের মতো কিছু আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব ছাড়াও স্বতস্ফূর্ত ভাবে বেরিয়ে আসছিল ক্ষোভ। কেন দিনের পর দিন মেয়েদের উপর এমন আক্রমণ হবে, কেন শুধুমাত্র প্রতিবাদ করার জন্যই চলে যেতে হবে বরুণের মতো মানুষকে, এই সব প্রশ্ন উঠে এসেছিল সেই বৈকালিক সভায়। অথচ সব উত্তরই তো জানা।
কামদুনির পাশে কীভাবে দাঁড়াচ্ছেন সুটিয়ার মেয়েরা?
|
নিহত বরুণ বিশ্বাস। |
২০০০ সাল থেকে গ্রামের কয়েক জন সমাজবিরোধীর দৌরাত্ম্যে সুটিয়ার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ধর্ষণ গ্রাম’। এক বছরে অন্তত ৩৩ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল সেখানে। দিনের পর দিন ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছে সুটিয়া। তার পর ২০০২ সালে তৈরি হয় প্রতিবাদী মঞ্চ। নিরন্তর ধর্ষণের প্রতিবাদে বরুণ বিশ্বাসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সেই মঞ্চ। তার পরে দীর্ঘ ১৩ বছরের লড়াই। সুটিয়ার মেয়েরা নিজেদের জীবন দিয়ে বুঝেছেন ধর্ষণ বা মেয়েদের উপর হিংসা থামাতে কেবল কয়েকটা প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, প্রয়োজন ধারাবাহিক লড়াই। আর তাই ১৩ বছরের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা দিয়ে কামদুনি থেকে গেদে থেকে গাইঘাটা, যেখানেই মেয়েরা নিগৃহীত হচ্ছেন, সেখানে ছুটে গিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চাইছেন তাঁরা। নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে নিজেদের মতো করে লড়াইটা লড়ে নেওয়ার সাহস আর পরামর্শ দিচ্ছেন, দেবেন— এই অসময়ে দাঁড়িয়ে এই শপথই নিয়েছে সুটিয়ার প্রতিবাদী মঞ্চ। ইতিমধ্যেই কলকাতায় শঙ্খ ঘোষের ডাকা মিছিল বা কামদুনির প্রতিবাদী মিছিলে পা মিলিয়েছেন তাঁরা। গ্রামে গ্রামে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে চাইছেন। ভয় না পেয়ে লড়াইয়ের সাহস জোগাচ্ছেন অন্যদের।
সুটিয়া গ্রামের দীপালি বিশ্বাস। প্রতিবাদী মঞ্চের মহিলা শাখার নেত্রী। আগের দিনই কামদুনি গ্রামে গিয়েছিলেন মিছিল করে। বলছিলেন, “গিয়ে দেখলাম, ওরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে। আমরা গিয়েছিলাম ওদের গ্রামে। সবাই বেরোলেন। কিন্তু টুম্পা আর মৌসুমীকে বের করা গেল না। টুম্পার মা বলছিলেন, কীভাবে মেরেছে মেয়েটাকে। বুকের নীচ অবধি ফালা ফালা করে দিয়েছে। এখনও ওখানে একটা আলো হল না, রাস্তা না। কিন্তু মেয়েদের তো রাত নেই, দিন নেই কাজ করতে হবে। ওই গ্রাম তো সকাল থেকেই থমথমে। মেয়েরা বেরোবে কী করে?”
সুটিয়া গ্রামের আর এক মহিলা পুষ্প বালা। জানালেন, তখন ২০০০ সাল। সুটিয়ার রাস্তায় মোড়ে মোড়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ওরা। সবার সামনে দিয়ে তুলে নিয়ে যেত মেয়েদের। বাবার সামনে, স্বামীর সামনে, সন্তানের সামনে মেয়েদের ধর্ষণ করত সুশান্ত চৌধুরীর লোকেরা। টাকা আদায়ের কৌশল। গ্রামের গরীব মানুষ কোনও কথা বলতে পারতেন না। পুষ্প বলেন, “আমাকেও বার কয়েক নিয়ে গিয়েছিল ওরা। রাত ১টা নাগাদ দরজায় কড়া পড়ত। দাদা, মানে সুশান্ত চৌধুরী ডাক পাঠাত কুঠিপাড়ায়, ওদের ডেরায়। বাড়ির ছেলেরাও ভয়ে কথা বলতে পারত না। আমারও ভয় করত। কিন্তু কথা তো আমাকে বলতেই হবে। আমি বলেছিলাম, কেন আমাকে নিয়ে এসেছেন এখানে। বাড়ি পৌঁছিয়ে দিন। আমি একা আসিনি, একা যাবও না।”
১০ বছর আগের ঘটনাগুলো এখনও দগদগে হয়ে আছে সুটিয়ার মানুষের স্মৃতিতে। প্রতিবাদী মঞ্চের সদস্য জগদীশ বাগচি বলেন, “আমরা গোপনে তৈরি করেছিলাম মঞ্চটা। তখন তো এ ভাবে বেরনো যেত না। সকল ধর্ষিতাকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাতাম আমরা। বরুণ সবাইকে ঘর থেকে বের করেছিল। কথা বলার সাহস জুগিয়েছিল। তার পর থেকেই তো একটা একটা করে মামলাগুলো হল। অপরাধীদের বেশির ভাগই এখন জেলে। যাবজ্জীবন হয়ে গিয়েছে।”
এক বছর আগে বরুণ বিশ্বাসের খুনের পরে আর একটা লড়াই শুরু হয়েছে সুটিয়ায়। বরুণ বিশ্বাসের খুনিদের শাস্তি চাই। কথায় কথায় বলেই ফেলেন দীপালি “যাদের পুলিশ ধরেছে, তারা তো আর খুনের মাথা নয়। খুনের পিছনে যারা বড় মাথা, তাদের ধরা হোক। তাদের শাস্তি হোক। বরুণের দিদি প্রমীলাও বলেন, “আমার ভাইয়ের মতো মানুষ, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারবে না, তা হয় না।”
এক দিকে ঘরের লড়াই, অন্য দিকে সারা রাজ্যে মেয়েদের উপর হিংসার বিরুদ্ধে একটা বৃহত্তর লড়াই জারি রাখা— গ্রামের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে সুটিয়া এখন প্রতিবাদের আর এক মুখ। মারা যাওয়ার এক বছর আগে বরুণ তাঁর খাতায় লিখেছিলেন, “একটু জায়গা রেখো নিজের মধ্যে/ আকাশ, উদ্যান, মরু, পর্বত, নদী, সময়।” দুঃসময়ে পাশাপাশি বসে বর্ষার বিকেলে সেই সময়ের সন্ধান করছিলেন সুটিয়ার এই মেয়েরা।
|