২০০২ সালের জুলাই মাসে সুশান্ত ধরা পড়ার পরেও তার চেলা-চামুণ্ডারা তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এলাকায়। জিতেন বালা নামে স্থানীয় এক শিক্ষকের বাড়িতে বসে খুব গোপনে ‘সংগঠিত’ হতে শুরু করেছিলেন স্থানীয় কিছু মানুষ। ঠিক হয়, সুটিয়া বাজারে মাইক বেঁধে সভা হবে।
ভিড় উপচে পড়েছিল সে দিনের সভায়। পর দিন
ফের সভা। সেখানেই ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’ গড়ে আন্দোলনের ‘শপথ’ নেন সুটিয়ার মানুষ। প্রথম দিন থেকেই বরুণ বিশ্বাস ছিলেন ওই আন্দোলনের সামনের সারিতে। আরও
ছিলেন ননীগোপাল পোদ্দার, জিতেন বালা, নীলরতন মজুমদার, হরিদাস বিশ্বাস, রতন মজুমদারের মতো ‘অকুতোভয়’ কিছু মানুষ।
কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলিকে সেই লড়াইয়ে কতটা পাশে পেয়েছিলেন আতঙ্কিত মানুষ? সুশান্ত চৌধুরীকে সিপিএমেরই একটি অংশ মদত দিত বলে অভিযোগ ছিল। সে কথা আগাগোড়াই অস্বীকার করেছেন দলের নেতারা। সুটিয়া-কাণ্ড নিয়ে আন্দোলনে নামে তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল। বিধানসভা সরগরম হয় গণধর্ষণ-কাণ্ড নিয়ে। আন্দোলন সংগঠিত করেছিল সিপিআই-ও। পরে রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রতিনিধি দল আসে সুটিয়ায়। রিপোর্ট পৌঁছয় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে। নড়ে বসে পুলিশ-প্রশাসন। একে একে ধরা পড়ে সুশান্ত ও তার দলবল।
গণধর্ষণ, খুন, খুনের হুমকি, তোলাবাজি মিলিয়ে এ পর্যন্ত সুটিয়া-কাণ্ডে ৩৩টি মামলা দায়ের হয়েছে। অভিযুক্ত ৩৮ জন। ২০টি মামলা শেষ হয়েছে। সুশান্ত, বীরেশ্বর ঢালি, রমেশ মজুমদার, রিপন বিশ্বাস, লক্ষ্মণ তরফদার, অনিল বালাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
সিপিআইয়ের বনগাঁ জোনাল কমিটির সম্পাদক রঞ্জিত কর্মকার বলেন, “স্থানীয় সিপিএমের একটা অংশ সুশান্তকে পরোক্ষে মদত দিত।” খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথায়, “আমরাই প্রথম সুটিয়া গণধর্ষণ-কাণ্ড নিয়ে
সরব হই। টনক নড়ে সিপিএম সরকারের।” কী বলছেন সিপিএম নেতৃত্ব? দলের গাইঘাটা (পূর্ব) লোকাল কমিটির সম্পাদক রমেন আঢ্য বলেন, “তৃণমূল এখন সব আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছে। আমরাই সে সময়ে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি।”
আন্দোলন তো চলছিল। কিন্তু কতটা নিরাপত্তা পেয়েছিলেন ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’-এর সদস্যেরা?
গত ৫ জুলাই গোবরডাঙায় দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হতে হয়েছে গণধর্ষণের একাধিক মামলার প্রধান সাক্ষী বছর উনচল্লিশের বরুণকে। ২০০৩ ও ২০১১ সালে প্রতিবাদী মঞ্চের সভাপতি ননীগোপালবাবুর উপরেও বোমা-বন্দুক নিয়ে হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। তাদের ‘পুরনো আক্রোশের’ জেরেই বরুণকে খুন হতে হল বলে মনে করেন বৃদ্ধ ননীগোপাল। বরুণ-খুনের পরে ননীগোপালবাবুকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী দিয়েছে সরকার। ননীগোপালবাবুর আফসোস, “এই নিরাপত্তাটুকু পেলে বরুণকে এমন অকালে চলে যেতে হত না।” তাঁর কথায়, “বরুণের উপরে ওদের পুরনো রাগ ছিল। সে জন্যই খুন হতে হল তরতাজা ছেলেটাকে। আমাকেও অনেক বার খুনের চেষ্টা করেছে। এখনও পারেনি। কবে কী ঘটবে, কে জানে!”
বরুণকে খুনের পিছনে আরও কিছু কারণ উঠে আসছে স্থানীয় মানুষের কথায়। এলাকার মানুষকে নিয়ে নানা সামাজিক আন্দোলনও করেছেন বরুণ। ইছামতী-যমুনা নদী সংস্কারের সময়ে ঠিকাদারেরা টাকা তছরুপ করছে বলে অভিযোগ ওঠে সম্প্রতি। এখানেও প্রতিবাদীদের সামনের সারিতে ছিলেন বরুণ। তার জেরেই এই খুন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে এলাকায়। গোবরডাঙার জামদানি এলাকায় একটি জমি থেকে বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা নিয়ে গোলমাল পাকিয়েছে। বরুণ সরব হয়েছিলেন ওই বাসিন্দাদের পক্ষ নিয়ে। তার জেরে আরও কিছু শত্রু তৈরি হয়েছিল তাঁর। খুনের ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরিতে এই বিষয়টি কোনও ভাবে কাজ করেছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে মানুষের।
কারণ যা-ই হোক, বরুণের ‘গ্রহণযোগ্যতা’ নিয়ে সুটিয়াবাসী এক রা।
তাঁর মৃত্যুর পরে দেহের পাশে রাত জেগেছে হাজার হাজার মানুষ। বরুণের ‘কর্মকাণ্ড’ নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ সুটিয়া। গণধর্ষণের শিকার বহু তরুণীর বিয়ে দেওয়া ছিল সেই কর্মকাণ্ডেরই অন্যতম দিক। পরিমল মণ্ডল, অনিতা বিশ্বাস, দিপালী বিশ্বাসেরা বলেন, “ওই মেয়েরা মানসিক ভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছিল। বরুণ একাই যেন সকলের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। নিয়মিত ওদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কথা বলত। বলত, জীবন একটা ঘটনায় থেমে যায় না। আবার সব কিছু শুরু করতে হবে নতুন করে।” ধর্ষণের শিকার এক তরুণীর কথায়, “বরুণদা না থাকলে এ ভাবে লড়াইটা চালিয়ে যাওয়ার জোর পেতাম না কিছুতেই। সব সময় বলত, জীবনটা অনেক বড়। শুধু একটু সাহস আর ধৈর্য্য ধরতে হয়। ওঁর শিক্ষা সারা জীবন মনে রাখব।”
তিন বোন দুই ভাইকে নিয়ে সংসার বরুণের বাবা জগদীশবাবুর। ভাইদের মধ্যে ছোট ছিলেন বরুণ। তাঁর দাদা অসিত বলেন, “বরাবরই খুব প্রতিবাদী স্বভাবের। সুটিয়ার মানুষ যখন এককাট্টা হচ্ছেন, ভাই ছিল তার সামনের সারিতে। আমরাও বাধা দিইনি। জানতাম, ও যা উচিত বলে মনে করে তার পক্ষে দাঁড়াবেই।”
এলাকার বহু দুঃস্থ মানুষের ‘দায়িত্ব’ নিয়ে ফেলেছিলেন উদ্যোগী তরুণটি। কার বইখাতা দরকার, কার দরকার রক্ত, কাকে নিয়ে যেতে হবে হাসপাতালে, কার মেয়ের বিয়ে আটকে টাকার অভাবে, কার বাড়িতে হাঁড়ি চড়েনি এ সব শুনলেই বরুণ এক পায়ে খাড়া। আর এ সব করতে গিয়ে টান পড়ত নিজের পকেটে। দাদা অসিতবাবু বলেন, “শিক্ষকতার চাকরি করে রোজগার ভালই ছিল। কিন্তু নানা মানুষকে আর্থিক সাহায্যের পরে মাসের শেষে মাঝে মধ্যেই টাকা চাইত। বলতাম, এত টাকা কী করিস বল তো! এক গাল হেসে বলত, “জানোই তো সব।” কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল না বরুণের। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে এলাকায় রাজনীতির কারবারিদের যে দাপাদাপি শুরু হয়েছে, তা স্থানীয় মানুষের না-পসন্দ। বরুণের পরিবারও চাইছেন না এমন কিছু। নিজের জীবন দিয়ে সুটিয়ার মানুষকে ফের একজোট করে গিয়েছেন বরুণ।
|