ত্রাসের সাঁড়াশি চাপ গলায়, মুখ ফুটছে না কামদুনির
পিছনে গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বারবার ফিরে তাকাচ্ছিলেন দুই তরুণী। আতঙ্ক তাঁদের চোখেমুখে।
মানুষ-সমান উঁচু পাটগাছের খেতের পাশের রাস্তা ধরে সজোরে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন ওই দু’জন। দু’মিনিটের জন্য থামতে বলায় আরও ভয় পেয়ে গেলেন তাঁরা। মুখে একটাই কথা, “দাঁড়াতে পারব না। বাড়ির লোক চিন্তা করছে।”
মঙ্গলবার বেলা তখন সবে সাড়ে ১১টা। এত চিন্তা কীসের যে, দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবে না!
দাঁড়ানো যাবে না। কারণ, কোচিং ক্লাস থেকে ফিরতে বোনেদের দেরি দেখে তত ক্ষণে যে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছেন তাঁদের দাদা। আর চিন্তা? সপ্তাহ তিনেক আগেই যে গ্রামের এক কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। কামদুনির বুকে সেই ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি যে এখনও দগদগে! তাই চিন্তা। এবং সেটা বিশেষ করে বাড়ির মেয়েদের জন্যই।
পুলিশি প্রহরাতেও আতঙ্ক কাটছে না কামদুনির বাসিন্দাদের।—নিজস্ব চিত্র
বারাসত ২ নম্বর ব্লক অফিসকে বাঁ হাতে রেখে কামদুনির দিকে যেতে সোজা প্রায় দু’কিলোমিটার অঞ্চলে পাটখেত, মাছের ভেড়ি। জনবসতি নেই। রাস্তায় আলো নেই। অটো বা তিন চাকার ভ্যানরিকশাও চলে না। গ্রামের মানুষ হেঁটেই যাতায়াত করেন। কারও ভরসা বড়জোর সাইকেল, কারও বা মোটরসাইকেল। সেই রাস্তাতেই এ দিন সকালে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাপিয়া ঘোষ আর সীমা ঘোষ। দ্বাদশ শ্রেণির দুই ছাত্রী সকাল ৯টায় গিয়েছিলেন কোচিং ক্লাসে। আড়াই ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরেও তাঁরা বাড়ি ফিরছেন না দেখে সাইকেল নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন তাঁদের দাদা তন্ময়।
এত ভয় কীসের?
তন্ময়ের কথায়, “খেতে মানুষ-সমান উঁচু পাট। ওর ভিতরে কিছু হলে কি কারও চোখে পড়বে? গ্রামে যা ঘটে গেল, তার পরে কি আর নিশ্চিন্ত থাকা যায়? মাঝেমধ্যে পুলিশের দেখা মেলে ঠিকই। কিন্তু তাঁরা তো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন। এতে কতটুকুই বা নিরাপত্তা মেলে!”
ধর্ষণ-খুনের পর থেকে কামদুনিতে ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশকর্মীরা পাহারা দেন। রাতে থাকে পুলিশ ভ্যান। খোঁজখবর করতে আসেন রিজার্ভ ব্যাটেলিয়নের কর্মীরাও। জায়গায় জায়গায় স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির ফোন নম্বর সেঁটে দেওয়া হয়েছে। একটি সংগঠনের তরফে মেয়েদের শ্লীলতাহানির ঘটনায় অভিযুক্তদের সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে পেটানোর নিদান দিয়ে পোস্টারও পড়েছে। কিন্তু কোনও কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছে না কামদুনি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, একটা পুলিশ ক্যাম্প তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু সেই ক্যাম্পের কাজ শুরুই হয়নি এখনও।
স্থানীয় ক্লাবগুলিতে রাত পর্যন্ত থাকেন গ্রামের পুরুষেরা। আতঙ্ক কাটিয়ে বেরোতে পারছেন না তাঁরাও। ক্ষুদিরাম ঘোষ নামে এলাকার এক বাসিন্দা বললেন, “একটি সংস্থায় গাড়ি চালাতাম। ঘটনাটার পর থেকে আর কাজে যেতে পারিনি। কাজটা খোয়াতে হল। এত দিন কামাই করলে কি আর চাকরি থাকে?”
আতঙ্কে স্কুলে যাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়েছে অনেক ছাত্রীর। অষ্টম শ্রেণির পরে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে হলে দেড়-দু’কিলোমিটার হেঁটে হয় বারাসত ২ নম্বর ব্লক অফিস, নইলে কামদুনি মোড় পর্যন্ত যেতে হয়। ব্লক অফিসের রাস্তার মতোই কামদুনি মোড়ে যাওয়ার রাস্তাও জনমানবহীন। গ্রামের সব ক’টি জলের কল খারাপ। তাই এই সব রাস্তা ধরেই দেড়-দু’কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পানীয় জল আনতে যান গ্রামবাসীরা। মোড় থেকে গ্রামের দিকে যেতে প্রথম আলোর স্তম্ভ নজরে পড়ে দেড় কিলোমিটার পরে। তার মাঝখানে রাস্তার দু’ধারে শুধুই ভেড়ি আর ভেড়ি।
তেমনই একটি ভেড়ির সামনে পাঁচিল ঘেরা জায়গায় কলেজছাত্রীর উপরে অত্যাচার চালায় দুষ্কৃতীরা। দুষ্কর্মের সেই জায়গাটা এড়িয়ে চলতে চায় কামদুনি। মেয়েরা তো বটেই, এমনকী সন্ধ্যার পরে গ্রামের ছেলেরাও একা ওই দিকে যাচ্ছেন না। ধৃতদের দলবল যদি হামলা চালায়!
অকুস্থলের ওই পাঁচিল গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন কামদুনিবাসী। কিন্তু তা হয়নি। এতে ক্ষুব্ধ নিহত তরুণীর পরিবার। তাঁর মায়ের কথায়, “পাঁচিল ভেঙে চুরমার করে দিক। নইলে আবার মা-বোনেদের টেনে নিয়ে যাবে ওই পাঁচিলের পারে।”
এলাকার মানুষজনই ওই পাঁচিল ভেঙে দেওয়ার আওয়াজ তুলেছিলেন। অভিযুক্তদের চরম শাস্তি চেয়ে পথেও নেমেছেন তাঁরা। তাঁদের প্রতিবাদ-আন্দোলন বিশিষ্টজনেদেরও পথে নামিয়েছে। তবু দুষ্কৃতীদের কোপ কখন কোন পথে ফের হানা দেয়, সেই ত্রাসে কুঁকড়ে আছে কামদুনি। সমাজবিরোধীদের অদৃশ্য রক্তচক্ষু এখনও এ ভাবেই শাসন করে চলেছে কামদুনিবাসীর দৈনন্দিন জীবন।
এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে নতুন এক ত্রাস।
সেই ত্রাসের চেহারাটা কেমন?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজেদের সমস্যার কথা শোনাতে গিয়েছিলেন স্থানীয় টুম্পা ও মৌসুমী কয়ালেরা। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের মাওবাদী বলে চিহ্নিত করেন। মমতার সেই মন্তব্যের প্রকাশ্য সমালোচনা করেছিলেন পাশের গ্রাম মহিষগদি-দাসপাড়ার বাসিন্দা অসীম দাস। অভিযোগ, শাসক দলের রোষানলে পড়ে আপাতত তিনি ঘরবন্দি। কাজেও যেতে পারছেন না। অসীমবাবু এ দিন বারবার বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করা উচিত হয়নি। আমি ভুল করেছি।” অসীমবাবুর বৌদি লক্ষ্মীদেবী ওই এলাকার পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলেরই প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন।
তৃণমূলের আদ্যন্ত সমর্থক ওই পরিবারটির যদি এই হাল হয়, অন্যদের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়। নাম প্রকাশ না-করার শর্তে এক বাসিন্দা বললেন, “গোটা এলাকাই তৃণমূলের শাসানিতে সিঁটিয়ে আছে। এমনকী তৃণমূলের লোকেরাও।”
ওই গ্রামে জেলা পরিষদের তৃণমূল প্রার্থী মতিয়ার সাঁপুই অবশ্য শাসানির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “গ্রামে তো কত রকম কথাই হয়! কেউ যদি অসীমকে জিজ্ঞাসা করে, ও মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করল কেন, সেটাকে কি শাসানো বলে?” এর পরেই মতিয়ার দাবি করেন, “অসীমবাবু সিপিএম করেন।”
অসীমবাবু অবশ্য জানান, তিনি তৃণমূলেরই সমর্থক।
শাসক দলের অনুগামী হয়েও তাদের শাসানিতে কাঁটা হয়ে থাকতে হচ্ছে বহু কামদুনিবাসীকে।
দুষ্কৃতীর অদৃশ্য থাবা তো আছেই।
জোড়া ত্রাসের সাঁড়াশি চেপে বসে আছে কামদুনির গলায়।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.