ভাবছি, এ বার মেয়ের পড়া বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দেব।
ভাবছেন না শুধু, স্পষ্ট বলছেনও এক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনীর মা। দিন চার আগে বারাসতের কামদুনিতে তাঁদের পাশের বাড়ির মেয়েকে রাস্তার পাশে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে।
“ঘটনার পর থেকে মেয়েটা দিন-রাত আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকছে। চমকে চমকে উঠছে” বলছেন সীমা নামে উঁচু ক্লাসের ওই ছাত্রীর মা কাজল ঘোষ। শুধু তাঁর নয়, আতঙ্কে বুক কাঁপছে কামদুনি, কৃষ্ণমাটি, ঘোষপাড়া, খড়িবাড়ির মা-মেয়েদের।
আতঙ্ক ওত পেতে আছে পথেই। দু’পাশে ভেড়ি। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। আলো নেই, পুলিশ নেই, নজরদারি নেই। শুধু পথের দু’পাশে লোভে চকচক করছে হিংস্র সব চোখ।
স্থানীয় কীর্তিপুর নবীনচন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের নবম শ্রেণির দুই ছাত্রী জানায়, স্কুলে যাওয়ার পথে বিভিন্ন জায়গায় মদ্যপ দুষ্কৃতীরা ছড়িয়ে থাকে। কটূক্তি ভেসে আসে। ভেড়ির পাশে চোলাইয়ের ঠেক থেকে নেমে জামা টেনে ধরে কেউ। সাইকেল জোরে চালিয়ে যেতে গেলে কেরিয়ার ধরে থাকে। ডিরোজিও কলেজের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীর কথায়, “অনেক ঘটনা ঘটে, যা কাউকে বলা যায় না। একটি মেয়ে খুন হয়েছে বলে এখন সব প্রকাশ্যে আসছে।”
ডিরোজিও কলেজের অধ্যক্ষ দিব্যেন্দু তলাপাত্র বলেন, “পরীক্ষা থাকলে বিকেল ৫টায় তা শেষ হয়। ছাত্রীদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। এলাকার পরিস্থিতি দিন-দিন খারাপ হচ্ছে।” কলেজের শিক্ষিকা চৈতালি মুখোপাধ্যায় বলেন, “খড়িবাড়ি এলাকা থেকে প্রচুর মেয়ে পড়তে আসে। বেশির ভাগই আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া বাড়ির মেয়ে। অনেক কষ্টে পড়া চালায়। সবাই যাতায়াতের সময়ে আতঙ্কে ভোগে।” |
কলেজের কোষাধ্যক্ষ সুজিত সেনশর্মা জানান, ওই এলাকা থেকে ছাত্রীদের কলেজে আসার হার কমে যাচ্ছে। অনেক পরিবার ভয়ে মেয়েদের আসতে দিচ্ছে না। টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নাজমুল হাসান গাজির প্রশ্ন, “যে পথে সামান্যতম নিরাপত্তা নেই, কলেজ শেষে মেয়েরা সেখান দিয়ে ফিরবে কী করে?”
দিনেদুপুরেও ওই এলাকা দিয়ে যেতে আতঙ্কে বুক কাঁপে কামদুনির সোনালি কয়ালের। তাঁর কথায়, “আমরা অভিভাবকেরা অনেক সময়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যাই। কিন্তু ওই এলাকায় যা মদ্যপদের দাপট, আমরাই সিঁটিয়ে থাকি। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কী করবে?” কামদুনির আর এক বাসিন্দা বলেন, “আমার মেয়ে ওই কলেজেই পড়ে। ও সে দিন একটা বাস পায়নি। দশ মিনিট দেরিতে পৌঁছয়। হয়তো সেই জন্যই বেঁচে গিয়েছে। আমার মেয়ের উপরেও ওদের নজর ছিল। কী ভাবে আর পড়াশোনা করবে?”
ইতিমধ্যে পড়াশোনা বন্ধও হয়েছে কারও কারও। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্থানীয় স্কুলে পড়ার পরে দূরের উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে আর যেতে পারেননি বছর কুড়ির পুতুল ঘোষ। হতাশ গলায় বলেন, “ভয়েই বাড়ির লোক পড়া বন্ধ করে দিতে বলেছিল।” ধর্ষণ-খুনের পর থেকেই আর স্কুলে যেতে চাইছে না রাজারহাটের আন্নাকালি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির প্রিয়া কয়াল। তার মতো ছোট ছোট আরও অনেক মেয়েরই এক অবস্থা। কামদুনির মৌসুমী কয়াল বলেন, “এত বড় ঘটনার পরে পুলিশ যখন দুষ্কৃতীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখনও তারা শাসিয়ে গিয়েছে যে ফিরে এসে বদলা নেবে। এই নৈরাজ্যে কে ঝুঁকি নেবে?” ডিরোজিও কলেজের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীর কথায়, “বাইরে থেকে নিজের এলাকায় ফিরে মানুষ তো নিশ্চিন্ত হয়। নিজের গ্রামের পথই যদি শ্বাপদের আস্তানা হয়ে ওঠে, নিরাপত্তা বলে কিছু আর থাকে কি?” |