বিচার চেয়ে জেলা সদরে পাড়ি দিল কামদুনি
ক্ষোভের স্ফূলিঙ্গ থেকে আগুনটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। পাড়ার চৌহদ্দি আগেই পেরিয়েছে। মঙ্গলবার তা ছুঁয়ে ফেলল ২০ কিলোমিটার দূরের জেলা সদরও। কামদুনির বাসিন্দারা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা এখানেও থামবেন না। কলেজ থেকে ফেরার পথে বেঘোরে ধর্ষিতা হয়ে প্রাণ হারানো মেয়েটার বিচার চাইতে প্রয়োজনে পৌঁছবেন মহাকরণের দরজায়। মুখ্যমন্ত্রী নীরব কেন প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
শুক্রবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত অবরোধ-বিক্ষোভ মূলত ছিল ওই ছাত্রীর বাড়ি থেকে দু’কিলোমিটার দূরে, কামদুনি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। সোমবার প্রতিবাদ পৌঁছয় আরও একটু দূরে, বারাসত-২ নম্বর বিডিও অফিসে, কামদুনি বাসস্ট্যান্ড থেকে যার দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। আর এ দিন উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসতেও পৌঁছে গেল বিক্ষোভের ঢেউ।
জ্বলেছে প্রতিবাদের শিখা। বারাসতের গণধর্ষণের প্রতিবাদে বাগুইআটিতে।
ওই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ধকল তো ছিলই, তার উপর সকাল থেকে প্রবল বৃষ্টি। ম্যাটাডর, মিনি ট্রাকে করে কামদুনি থেকে বারাসতে যাওয়া নিহত ছাত্রীর পড়শিরা অবশ্য তাতে এতটুকু দমেননি। প্রথমে তাঁরা জড়ো হন বারাসতের কাছারি ময়দানে। হাতে হাতে ছিল পোস্টার-প্ল্যাকার্ড ‘গণধর্ষণ-খুনের বিচার চাই’। ভিড় এগোয় চাঁপাডালি মোড়ের দিকে। সেখানে মিছিলে যোগ দেন সুটিয়ার নিহত শিক্ষক বরুণ বিশ্বাসের তৈরি ‘প্রতিবাদী মঞ্চে’র সদস্যরা।
সুটিয়ার ওই সংগঠনের সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দার বলেন, “কামদুনির ঘটনা শিউরে ওঠার মতো। বছর দশেক আগে সুটিয়াতেও পরপর ওই রকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল। দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য রুখতে গিয়েই বরুণ প্রাণ দিয়েছে। সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কামদুনির মানুষ যাতে ভয় না-পান, তাই আমরা এগিয়ে এসেছি। আমরা ওঁদের পাশে আছি।” বারাসতের বিভিন্ন বয়সের বেশ কিছু বাসিন্দা এসে মিছিলে পা মেলান। নৈহাটি থেকেও এসেছিলেন অনেকে।
প্রতিবাদীদের সড়ক অবরোধ চাঁপাডালি মোড়ে।
স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের সঙ্গে যাতে কোনও ধর্মীয় বা রাজনৈতিক রং না-মিশে যায়, কামদুনির মানুষ সেটাও সচেতন ভাবে মাথায় রাখছেন। এ দিন তাঁরা যখন বারাসত পৌঁছন, সেই সময়ে চাঁপাডালি মোড়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল একটি সংগঠন। তাদের দাপটে যশোহর রোডে যান চলাচল থমকে যায়। এমনকী কয়েকটি গাড়িতে ভাঙচুরও চালানো হয় বলে অভিযোগ। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামলায়।
সেই চাঁপাডালি মোড়ে পৌঁছনোর পর কামদুনির বিক্ষোভকারীরা জানিয়ে দেন, কোনও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মঞ্চের সঙ্গে এই আন্দোলনকে তাঁরা জুড়তে চান না। তাই মিছিল ঘুরিয়ে তাঁরা চলে যান বারাসত আদালতের দিকে। ততক্ষণে ওই আদালতের আইনজীবীদের ধিক্কার-মিছিল রওনা দিয়েছে থানার দিকে। আইনজীবীরা জানান, রাজীব দাসের হত্যাকাণ্ডের পর যেমন তাঁদের কেউ দুষ্কৃতীদের পক্ষে সওয়াল করেননি এ ক্ষেত্রেও তা-ই হবে।
এ দিন দুপুরে ওই ছাত্রীর কলেজ, ডিরোজিও কলেজে ছিল তাঁর স্মরণসভা। ক্ষোভ-প্রতিবাদের আঁচ ছিল সেখানেও। কলেজের অধ্যক্ষ দিব্যেন্দু তলাপাত্র বলেন, “আমাদের বহু ছাত্রীকে ওই ভেড়ির বিপজ্জনক পথ দিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি খুব জরুরি। ওই রাস্তায় অবিলম্বে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প করার জন্য আমরা কলেজের পক্ষ থেকে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে লিখিত ভাবে আবেদন করব।”
গত শনিবারই অবশ্য রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওই এলাকায় পুলিশ ক্যাম্প বসানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোনও চিহ্ন নেই। ফলে এলাকাবাসী ক্রমশ ধৈর্য হারাচ্ছেন। সেই সঙ্গে তাঁদের প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন এখনও পর্যন্ত ওই ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করলেন না? নিহত ছাত্রীর পরিবার-পরিজনের পাশে কেন তিনি দাঁড়াননি? ধর্ষণ ও খুনে মূল অভিযুক্তদের মধ্যে এক জন এখনও অধরা কেন, সেই প্রশ্নও তুলছেন কামদুনির বাসিন্দারা।
সন্ধ্যা গড়াতে বারাসত থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের বাগুইআটিতে জ্বলে উঠেছে প্রতিবাদের মোমবাতি। সেই মোমবাতি মিছিলে সামিল হয়েছেন কয়েকশো মানুষ। মিছিলের উদ্যোক্তাদের অন্যতম, বিশ্বজিৎ বাগুইয়ের কথায়, “আমরা ভাবতে পারিনি, এত মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই নীরব মোমবাতি মিছিলে যোগ দেবেন। আসলে ওই কলেজছাত্রীর সঙ্গে যা হয়েছে, তা কোনও বিশেষ এলাকার নয়, গোটা রাজ্যের লজ্জা।”
কামদুনিবাসী গোড়া থেকে রাজনীতির সংশ্রব এড়াতে চাইলেও এ দিন যুব কংগ্রেসের সদস্য-সমর্থকেরা বারাসত থানা ঘেরাও করে স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাঁদের বিক্ষোভে কে এন সি রোড অবরোধ হয়। স্মারকলিপি দেওয়ার পর কামদুনি গ্রামে গিয়ে নিহত ছাত্রীর পরিজনদের সঙ্গে দেখা করেন রাজ্য যুব কংগ্রেসের সভাপতি শৌমিক হোসেন, সাধারণ সম্পাদক জিতেন্দর বাঘেল-সহ নেতারা। এখনও পর্যন্ত ওই ঘটনায় ধৃত আট জনকে এ দিন বিকেলে বারাসত থেকে সিআইডি-র সদর দফতর ভবানী ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। দ্রুত তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দিতে স্পেশ্যাল সুপারের নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল তৈরি করেছে সিআইডি।
কিন্তু পুলিশি তদন্তে এলাকাবাসীর জীবনযাপনে কতটা ভরসা ফিরবে, প্রশ্নটা থাকছেই। এর কারণও একটাই।
বারাসত বদলায় না। বদলায় না লাগোয়া জনপদগুলোর নৈরাজ্যের ছবি। কখনও দিদির সম্মান বাঁচাতে গিয়ে খুন হন ছাত্র রাজীব দাস, কখনও মেয়ের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে রাস্তায় বেধড়ক মার খান বাবা, মাস পাঁচেক আগেও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে নীলগঞ্জে। তার পর বিক্ষোভ, অবরোধ, নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির চেনা ছবি। শুধু খবরের কাগজের শিরোনাম জীর্ণ হতে থাকে ‘বারাসত আছে বারাসতেই’।
—নিজস্ব চিত্র

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.