সেনা-আধাসেনাই মুছছে সরকারি ব্যর্থতার কলঙ্ক
প্রতি পলে মৃত্যু-ছোবল, জীবনরক্ষায় যুদ্ধ তাঁদের
দুর্গম পাহাড়ে, দুর্যোগের মধ্যে এখনও যাঁরা আটকে রয়েছেন, তাঁদের ভরসা জোগাতে গত কালই কথাগুলো বলেছিলেন বায়ুসেনা-প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল এন এ কে ব্রাউন। “আপনাদের প্রত্যেককে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে না দেওয়া পর্যন্ত আমাদের কপ্টারের পাখা থামবে না।” কিন্তু সেটা যে কত কঠিন শপথ, গৌরীকুণ্ডে আজ মর্মান্তিক প্রমাণ মিলল তার।
মুখে কঠিন আত্মবিশ্বাসের বর্ম ধরে রেখেও পাইলটরা কবুল করছেন, লড়াইটা সত্যিই বেশ শক্ত। কারণ, এমনিতেই পাহাড়ি এলাকায় কপ্টার ওড়ানো যথেষ্ট কঠিন। এর উপর আবহাওয়া এখন খুবই খারাপ। বহু ক্ষেত্রে দুর্যোগের মধ্যেই দুই পাহাড়ের মধ্যে খুবই সঙ্কীর্ণ পরিসরে উড়তে হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে সংঘর্ষের আশঙ্কা। সকলেই তাই যতটা সম্ভব ডান দিকের পাহাড় ঘেঁষে উড়ছেন। যাতে মুখোমুখি দু’টি কপ্টার চলে এলেও সংঘর্ষের সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু এত সতর্কতাতেও এড়ানো গেল না ক্ষতি। বায়ুসেনার অত্যাধুনিক চপার হেরে গেল প্রবল বৃষ্টি ও নজর না-চলা কুয়াশার কাছে। থেমে গেলেন দুর্গতদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া ক’জন অসমসাহসী মানুষ।
সামরিক বাহিনীর তরুণতম জওয়ান থেকে শীর্ষ কর্তাদের কিন্তু থমকে যাওয়ার সময় নেই। উত্তরাখণ্ডে এ দিনও জোর কদমেই চলেছে ‘অপারেশন সূর্য আশা’। অব্যাহত বায়ুসেনার ‘অপারেশন রাহত’। বিরতি পড়েনি বন্যা-দুর্গতদের উদ্ধারের অভিযান ‘অপারেশন গঙ্গা পরাহর’-এও। সেনা-কর্তারা বলছেন, এই প্রতিটি অভিযানের ক্ষেত্রেই সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল, ভৌগোলিক প্রতিকূলতা ও সময়কে টক্কর দেওয়া। ফের আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগেই যতটা সম্ভব উদ্ধারের কাজ সেরে ফেলার কঠিন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে প্রতি দিন। প্রাথমিক ভাবে উত্তরাখণ্ডে ৫০০ জন জওয়ানকে নামানো হয়েছিল। এখন সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে ৬ হাজার। সেনা, বায়ুসেনা মিলিয়ে গোটা ষাটেক হেলিকপ্টার প্রতি দিন চক্কর কাটছে দেবভূমির আকাশে। প্রথম দিকে কপ্টারের জ্বালানির অভাব দেখা দিচ্ছিল। কাজে নামানো হয় সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস বিমানকে। ৮ হাজার লিটার জ্বালানি নিয়ে ধারাসুর ‘অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড’-এ নেমে পড়ে হারকিউলিস। মাত্র ১৩০০ ফুট রানওয়ে। তার মধ্যেই দানবাকৃতি বিমান নামিয়ে ফেলেন পাইলট। বেশি ভার বহন করতে হলে কপ্টারকুলে ভরসা এমআই-২৬। তাদের দিয়ে আগেই এনে রাখা হয়েছিল জ্বালানি ভরে রাখার বিশাল বিশাল ট্যাঙ্কার। এখন ধারাসু থেকেই জ্বালানি ভরে একের পর এক কপ্টার উদ্ধারের কাজে উড়তে শুরু করেছে। কপ্টার ও বিমানে শুধু যে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করা হচ্ছে বা ত্রাণ পৌঁছনো হচ্ছে, তা নয়। ভেঙে পড়া সেতু ও সড়ক মেরামতির ভারী যন্ত্রপাতি, উপকরণও এ ভাবেই দুর্গম এলাকায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পৌঁছে দিতে হচ্ছে অন্ত্যেষ্টি বা গণচিতার কাঠও।
গুপ্তকাশী থেকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খাবার বোঝাই কপ্টার।
বদ্রীনাথে আটকে পড়া দশ হাজার মানুষকে উদ্ধারের জন্য অলকানন্দা নদীর উপরে পায়ে হেঁটে পারাপার করার মতো একটি সেতু বানানো হয়েছিল। শুক্রবার জলের তোড়ে তা ভেসে চলে যায়। এর পর থেকে দড়ির সেতু তৈরি করেই কাজ চলছিল। গত কাল বহু কসরতের পর গাড়ি চলাচলের জন্য একটি অস্থায়ী সেতু তৈরি করতে পেরেছেন সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা। অলকানন্দার বুকেই পাথর কেটে তৈরি হয়েছে হেলিপ্যাড। দু’টি হেলিপ্যাড তৈরি হয়েছে গৌরীকুণ্ডেও। তারই কাছে আজ ভেঙে পড়ে বায়ুসেনার ব্যারাকপুর ইউনিটের চপারটি।
সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলাপরায়ণ সদস্য হিসেবে শুধু নয়, ব্যক্তিগত ভাবেও অনেক সেনাকর্মী দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন প্রতি দিন। গোর্খা রাইফেলসের মেজর মহেশ কারকি যেমন স্ত্রী, দুই সন্তান, শাশুড়িকে নিয়ে নিজেই ছুটি কাটাতে যাচ্ছিলেন দেরাদুন থেকে বদ্রীনাথে। রাস্তায় ধস নামে জোশীমঠের কাছে। গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে আসতে পারতেন। কিন্তু উল্টো দিকে তখন ২৫ জন আটকে রয়েছেন। পরিবারের সকলকে অপেক্ষা করতে বলে একাই উদ্ধারে নেমে পড়লেন। এক-এক বারে ৪ জন করে পার করিয়ে আনলেন ভাঙা রাস্তা। তার পর তাঁদের গোবিন্দঘাটে সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিলেন।
সেনা-প্রধান জেনারেল বিক্রম সিংহ জানান, দুর্গম এলাকায় আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারের জন্য ১০টি বিশেষ পর্বতারোহী বাহিনী নামানো হয়েছে। কেদারনাথ, জঙ্গলচটি, রামাওয়াড়া এলাকায় তারা পাহাড়ের কোণে-খাঁজে হাতড়ে চলেছে, যদি কেউ জীবিত আটকে থাকে কোথাও। শুধু রবিবারই এ ভাবে পাহাড়ে আটকে থাকা প্রায় এক হাজার মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে।
বিরোধীরা বলছেন, সেনা ও আধাসেনাদের এই তৎপরতার কিছুটাও যদি সরকারের তরফে দেখা যেত, তাতে হয়তো এত মানুষের প্রাণহানি হত না। হাজার হাজার মানুষকে সমস্যাতেও পড়তে হত না। হিমালয়ের দেশে সুনামি মাপের বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পর থেকেই এই জাতীয় সমালোচনা শুনতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। কারণ বিপর্যয়ের পরে ত্রাণ-উদ্ধারের প্রথম ক’দিনের ছবিটা ছিল খুবই হতাশাজনক। ফলে প্রশ্ন ওঠে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার কতটা সক্ষম, তা নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করা হয় বিভিন্ন মহল থেকে। বিরোধীরা জানতে চান, বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপদ-সঙ্কেত থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্র কেন তাতে কান দেয়নি?
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই সরকারের একটি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কমিটি রয়েছে। ক্যাবিনেট মন্ত্রী, আমলা থেকে শুরু করে পরিবেশবিদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা তার সদস্য। একই ভাবে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্যও রয়েছে আর একটি উচ্চস্তরের কমিটি। সেই কমিটিরও সভাপতি প্রধানমন্ত্রী নিজে। আবার যোজনা কমিশনেও দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য আলাদা কমিটি রয়েছে। এই তিন কমিটি কী করল? তাদের সুপারিশেরই বা কী হল? সরকারি সূত্রের খবর, বিপর্যয় মোকাবিলা নিয়ে কমিটিগুলি তাদের রিপোর্ট তৈরি করে এ বিষয়ে সরকারকে সতর্কও করেছিল। কিন্তু নিজেদের তৈরি কমিটির রিপোর্টেই কান দেয়নি কেন্দ্র।
বিপদে পড়ার পরে ভরসা এখন স্থলসেনা, বায়ুসেনা, ভারত-তিব্বত পুলিশ (আইটিবিপি) ও সীমান্ত সড়ক সংস্থা। উত্তরাখণ্ডে বিপর্যয় নেমে আসার প্রায় দশ দিন পরে দিল্লির রাইসিনা হিলে সকলেই একমত যে, সেনা ও অন্যান্য আধাসেনা বাহিনী না থাকলে আরও মুখ পুড়ত সরকারের। নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি সয়েও সামরিক বাহিনীগুলি কার্যত সরকারের মুখ বাঁচানোর দায়িত্বই কাঁধে তুলে নিয়েছে।
আর কী বলছে সরকার? সমালোচনার মুখে পড়ে কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারির জবাব, “এখন আমাদের নজর উদ্ধারকাজের দিকে। আগে সেটা শেষ হোক। পরে এ সবের ময়না তদন্ত করা যাবে।”

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.