|
|
|
|
বিমানবন্দরের দেওয়াল জুড়ে নিরুদ্দেশ সংবাদ |
অগ্নি রায় • দেহরাদূন |
রিমঝিম শর্মা। বয়স সাত। জেলা, মোরাদাবাদ। রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ। গুমসুদা।
এমন একটি অভিশপ্ত দেওয়াল আগে কখনও দেখিনি। দেখিনি এমনতর দেওয়াল লিখনও।
জলি গ্রান্ট বিমানবন্দরের দু’নম্বর গেটের গায়ের দেওয়ালটি যেমন। অসংখ্য কম্পিউটার প্রিন্ট আউটে শিশু-মুখের ছড়াছড়ি। সঙ্গে তাদের বাবা-মায়ের ছবি এবং নাম-নিবাস।
এই শিশুরা, তাদের বাবা-মায়েরা পাহাড়ে হারিয়ে গিয়েছেন। তিন-চার দিনের চিরুনি তল্লাশিতেও এখনও এঁদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। জলি গ্রান্ট এখন এক অনন্ত প্রতীক্ষালয়ে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকে হাতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রিয়জনদের ছবি। একটি কপ্টার নামলেই দৌড়ে চলে যেতে চাইছেন গেট পেরিয়ে।
স্ত্রী, মা এবং শিশুকন্যাকে হারিয়ে প্রায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন অযোধ্যার সন্তোষকুমার পান্ডা। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তীর্থে পাঠিয়েছিলেন পরিবারকে। স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, “বেঁচে আছে কিনা সেটা তো অন্তত জানা দরকার। না হলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে যেতে হবে।” |
|
স্বস্তি। জলিগ্রান্ট বিমানবন্দরে নামার পর। ছবি: পিটিআই। |
ত্রাণের প্যাকিং বাক্সে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন ঋতেশ কেশরওয়ালি। কান্না বা বিলাপ নেই, শোকে পাথর। “আমার সঙ্গে ১৬ তারিখ সকালে যখন কথা হল, তখনও মা বলল, বিপদটা কাটিয়ে উঠেছি। একটা নিরাপদ জায়গায় আছি।” সেই শেষ কথা। “কোন নিরাপদ জায়গায় ছিল, সেখানেই থেকে গেল কিনা, কিছুই বুঝতে পারছি না।” ছত্তীসগঢ়ের বিলাসপুরে একটি কয়লা সংস্থায় সদ্য চাকরি পেয়েছেন ঋতেশ। বাবা-মা-ভাই-বোন অনেক করে বলা সত্ত্বেও ছুটি পাবেন না বলে সঙ্গে যেতে পারেননি। সেই তিনিই গত পাঁচ দিন ধরে ঠায় বসে রয়েছেন জলি গ্রান্টের সামনের ধানখেতে তৈরি হওয়া অস্থায়ী তাঁবুতে। পরিবারের ছ’জনই নিখোঁজ। এমনকী প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে ‘সেফ লিস্ট’ দেওয়া হয়েছে, সেখানেও তাঁদের নাম নেই।
এই সব অসহায়তার কোনও সান্ত্বনা হয় না। গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, মহারাষ্ট্র বিভিন্ন রাজ্যের যে সব মানুষ জলি গ্রান্টে ঠায় অপেক্ষা করে চলেছেন, এই একই অসহায়তার অভিব্যক্তি তাঁদের সকলের চোখেমুখে। তবে চোখে পড়ল না কোনও বঙ্গসন্তানকে। রাজ্যের রেসিডেন্ট কমিশনার ভাস্কর খুলবে জানাচ্ছেন, “এখানে যারা আসছেন, তাদের বেশির ভাগকেই উত্তরকাশী থেকে আনা হচ্ছে। আমাদের হিসেব মতো এখনও ৫০০ জন বাঙালি আটকে রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা সবাই প্রায় রয়েছেন বদ্রীনাথে।” এই ৫০০ জনের মধ্যে কমবেশি ১৭০-৮০ জনের নামের তালিকা রয়েছে। এঁদের মধ্যে ১৪৫ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা গিয়েছে। খবর এসেছে, হাওড়ার দুই ট্রেকার সুরজিৎ পাল চৌধুরী এবং দেবাশিস পাল আটকে রয়েছেন পিথৌরাগড় জেলার নাগলসিং গ্রামে। পিথৌরাগড় জেলাশাসককে অনুরোধ করা হয়েছে যাতে তাঁরা এঁদের উদ্ধারে সাহায্য করেন।
ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিশ্রম করে চলেছেন সেনাবাহিনী, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্তারা। আজও আবহাওয়া খারাপ থাকার জন্য সকাল থেকে কোনও চপার গিয়ে উদ্ধারকাজ চালাতে পারেনি। স্যাটেলাইট ফোনে পাহাড়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সব রকম চেষ্টা চলছে। সাহায্য এবং বেসরকারি ত্রাণে এই মূহূর্তে কমতি নেই। পাহাড়ের বহু বাঁকে গিরিপথে কার্যত লঙ্গর খুলে বসেছে বহু সমাজসেবী সংস্থা। উপর থেকে গাড়ি নামলেই স্বেচ্ছাসেবীরা দৌড়ে যাচ্ছেন জলের বোতল হাতে। |
|
বিমানবন্দরের দেওয়ালে ছবি লাগিয়েই চলছে স্বজনের খোঁজ। ছবি: এএফপি। |
ত্রাণের রাজনীতিতে সবার আগে রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত। প্রচুর লঙ্গর খোলা হয়েছে মোদী-রাজ্যের তরফে। সেই রাজ্যের অনেক গেরুয়াধারী সাধুকেই দেখছি রান্নার কাজে হাত লাগাতে। মোদীর গুণগানও লোকের মুখে মুখে ফিরছে। মোদী নাকি প্রায় ১৫ হাজার লোককে নীচে নামিয়ে এনেছেন বলে রটনা শোনা যাচ্ছে। বস্তুত বিভিন্ন রাজ্যের তরফে নিজেদের লোকজনকে আগে উদ্ধার করার চেষ্টা নিয়ে কিছুটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছে। গুজরাত, মধ্যপ্রদেশের মতো কিছু রাজ্য নিজেরা বেশ কিছু চপার মজুত করেছে। তাই নিয়ে উত্তরাখণ্ডের কংগ্রেস সরকার কিছুটা চাপেও পড়েছে। খারাপ আবহাওয়ায় অবশ্য দু’দিন ধরে কোনও চপারই নড়তে পারেনি। এখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে যে, চপার যা লাগবে তা উত্তরাখণ্ডই দেবে। বাড়তি চপার লাগলে কেন্দ্র দেবে। অন্য কোনও রাজ্য যেন চপার মজুত না করে।
চামোলি জেলার এসপি অজয় জোশী এ দিন বললেন, “এখন সেনাবাহিনী ও উত্তরাখণ্ড সরকার ছাড়া আর কাউকে উদ্ধারকাজে নাক গলাতে দেওয়া হচ্ছে না। বয়স্ক, অসুস্থ ও ছোটদের আগে সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।” |
|
|
|
|
|