|
|
|
|
বদ্রীতে এখনও আটক বহু |
মায়ের স্যালাইনের নল হাতে নিয়েই কপ্টারে উঠলেন মেয়ে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
তিন দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে হেলিকপ্টারে ঠাঁই পেয়েছিলেন ৭১ বছরের প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ। বদ্রীনাথ থেকে গোচরে নেমে তিনি পুরোপুরি দমছুট। সঙ্গী-পরিচিতেরা অনেকেই ছুটতে ছুটতে দেহরাদূনের হেলিকপ্টারে উঠে পড়লেও তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেননি রমেন্দ্রনাথ জোয়ারদার। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে স্ত্রী শিপ্রাকে নিয়ে দিনের শেষ উড়ানে ফের কপ্টারে ওঠার সুযোগ পেলেন তিনি।
সন্ধ্যায় দেহরাদূনে পৌঁছে রমেনবাবু বলছিলেন, কেদার-দর্শন সেরে পিপুলকোটি হয়ে বদ্রীনাথে উঠেছিলেন গত ১৪ এপ্রিল। দু’দিনের ব্যাপার! তাই পিপুলকোটিতেই রেখে গিয়েছিলেন নিজের ওষুধপত্র, প্যান কার্ড থেকে শুরু করে অধিকাংশ দরকারি জিনিসপত্র। কিন্তু বদ্রীতেই আটকে দিল প্রকৃতি। ভ্রমণ সংস্থার কর্মীদের সৌজন্যে ডাল-ভাত-তরকারি জুটে গিয়েছে। কিন্তু ১০-১২ দিন ধরে গ্লুকোমার ওষুধ আর দিতে পারেননি চোখে। পরপর দু’দিন কাকভোরে বদ্রীনাথের হেলিপ্যাডে গিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু ভিড় আর ঠেলাঠেলির চোটে কপ্টারে উঠতে পারেননি। তৃতীয় দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার ভাগ্য খুলল।
বাগুইআটির কমলা চট্টোপাধ্যায়ের অবস্থা আরও সঙ্গিন। একটানা ১০-১২ দিন বদ্রীনাথে অত উঁচুতে পড়ে থেকে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ৭৫ বছরের বৃদ্ধা। কোনও মতে স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কমলাদেবীর সঙ্গী, মেয়ে অনিতা দে পরপর ক’দিন মায়ের জন্য রাত জেগে হেলিকপ্টারের লাইনে দাঁড়িয়েছেন। সকালে মাকে নিয়ে এসেও লাভ হয়নি। কপ্টারে ওঠা যায়নি। “অবাক হয়ে দেখলাম, ৩৫-৩৬ বছরের সব ছেলেমেয়ে কত রকমের চেনা-জানা দেখিয়ে আমাদের আগে হেলিকপ্টারে উঠে পড়ল। কেউ ভাবল না, আমার অসুস্থ মায়ের কথা! এরা কী মানুষ!”— ঝাঁঝিয়ে উঠে বলছিলেন অনিতা। এ দিন সকালে ২৮৩ নম্বর লেখা টোকেন হাতে হেলিপ্যাডে পৌঁছে সটান সেনাবাহিনীর ডাক্তারের দ্বারস্থ হন তিনি। কমলাদেবীর অবস্থা দেখে চিকিৎসক ঝুঁকি নিতে চাননি। এক হাতে মায়ের স্যালাইনের নল, অন্য হাতে মাকে ধরে শেষমেশ হেলিকপ্টারে ওঠেন অনিতা। এ দিন সন্ধ্যায় মা-মেয়ে দেহরাদূন পৌঁছেছেন। স্থানীয় হাসপাতালে মাকে দেখানোর পরে ডাক্তারেরা অবশ্য অনিতাকে কিছুটা অভয় দিয়েছেন। |
|
বাড়ির পথে। মঙ্গলবার হাওড়া স্টেশনে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার। |
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, বালানন্দ আশ্রম, কালীকমলি ইত্যাদি জায়গা মিলিয়ে এখনও পশ্চিমবঙ্গের কম-বেশি ১৭০-৮০ জন বদ্রীনাথে আটকে। কলকাতার কুণ্ডু স্পেশাল, বাঁকুড়া, হুগলির দু’টি বড় দল ছাড়াও বিচ্ছিন্ন ভাবে এসেছেন অনেকে। বেশির ভাগই বয়স্ক। মহাকরণে দাঁড়িয়ে এ দিনই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, বাংলার লোকেদের ফেরাতে দেহরাদূন বা দিল্লি থেকে চার্টার্ড বিমানের ব্যবস্থা হচ্ছে। তাঁর কথায়, “ট্রেনে আসতে সময় লাগবে। তাই বিমানের ব্যবস্থা। এ হল রাজ্যের মানুষের জন্য আমাদের নৈতিক কর্তব্য ও দায়িত্ব।”
উদ্ধারের তদারকিতে উত্তরাখণ্ডে পাড়ি দেওয়া দুই মন্ত্রীর মধ্যে মদন মিত্র এ দিন ফেরার ট্রেন ধরেছেন। রচপাল সিংহ এখন হরিদ্বারে। তিনি বললেন, “বাংলার ১২৮৪ জন ফিরে গিয়েছেন। সারা দিনে খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী বার আশপাশের এলাকা থেকে ৬৮ জন নামতে পেরেছেন। তাঁরা রাতে ট্রেনে উঠবেন।” রাজ্য চার্টার্ড বিমানের ব্যবস্থা করলেও একসঙ্গে ১০২ জনকে না-পেলে লাভ হচ্ছে না। রচপাল জানান, বদ্রীনাথ থেকে নামা সারদা মঠের চার বৃদ্ধা, অসুস্থ সন্ন্যাসিনীকে বুধবার সকালের উড়ানে কলকাতা ফেরানো হবে। গুপ্তকাশী-রুদ্রপ্রয়াগে ধসের জেরে জোশি মঠ থেকে টিহরির সড়কে চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। রুদ্রপ্রয়াগে আটক ২৭ জনের একটি দলকেও নীচে নামতে সাহায্য করছে রাজ্য।
এ সব বিক্ষিপ্ত হিসেবের বাইরেও রাজ্যের অনেক তীর্থযাত্রী-পর্যটকেরই খোঁজ নেই। সব মিলিয়ে সেই সংখ্যাটা ৫০০-র কাছাকাছি হতে পারে বলে খবর। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, নিরাপদ জায়গায় যাঁরা নামতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে ৩৫০ জনকে ফিরিয়ে এনেছে রাজ্য সরকার। কেউ কেউ নিজেরা ফিরেছেন। তাঁদেরই এক জন সিঁথির ইন্দ্রাণী ত্রিবেদী। ১৬-২০ এপ্রিল (রবি থেকে বৃহস্পতি) কেদারের রাস্তায় সীতাপুরে বন্দি ছিলেন তিনি। দেখেছেন, প্রলয়ের বৃষ্টি আর হোটেলের পাশে ফুঁসতে থাকা গঙ্গা। মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। বৃদ্ধার ছেলে সপ্তর্ষি বলছিলেন, “আমি ভয়ে টিভি খুলতাম না। রোজ একবার ভ্রমণ সংস্থার অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতাম মা কোথায়, কিছু জানা গেল কিনা!” এ দিনই দুন এক্সপ্রেসে ফিরেছেন ইন্দ্রাণী। তাঁর কথায়, “১৬ তারিখ বৃষ্টি শুরু হল বলে আমরা গৌরীকুণ্ডের দিকে এগোইনি। একটা দিন আগে সীতাপুরে পৌঁছে রওনা হয়ে গেলে কী হতে পারত, ভেবেই শিউরে উঠছি।” |
|
|
|
|
|