একে একে ফিরছেন ওঁরা। ওঁদের সঙ্গে ফিরছে বানভাসি উত্তরাখণ্ডের ভয়াবহ সব স্মৃতি।
মঙ্গলবার সকালে দুন এক্সপ্রেস থেকে বর্ধমানে নামেন গৌরীকুণ্ডে আটকে থাকা বাবা-মা আর ছেলে। আসানসোলে পৌঁছেছেন দুই ইসিএল কর্মী। উত্তরাখণ্ডে আটকে থাকা ৭৪ জন ফিরেছেন ওই ট্রেনে। তার মধ্যে সাত জন বর্ধমানের তবে এখনও অনেকেরই ফেরা বাকি।
বর্ধমান শহরের শ্যামবাজারের অপর্ণাঘাটের রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় চাকরি করেন দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে। গত ১২ জুন স্ত্রী সবিতা আর ছোট ছেলে শুভাশিসকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কেদারনাথের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণবাবুর বয়স ষাট ছুঁই-ছুঁই। তাঁর স্ত্রী পঞ্চাশ পেরিয়েছেন, ছেলে মধ্য তিরিশের যুবা। ফি বছরই তাঁরা নানা জায়গায় বেড়াতে যান। কখনও তেমন দুর্যোগে পড়েননি। এ বার সেই নিয়মটা পাল্টে গেল। রামকৃষ্ণবাবুর কথায়, “কেদারে পৌঁছোতে পারিনি। যে রাতে আমরা গৌরীকুণ্ডে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রমে, পাহাড়টা যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে প্রবল বৃষ্টি আর অন্ধকারে হাতড়ে হেঁটে চললাম। মাথা গোঁজার জায়গা হল কাছেই গৌরীগাঁওয়ে। সেখানে টানা চার দিন খোলা আকাশের নীচে থাকতে বাধ্য হই। খাওয়া জোটেনি। চোখের সামনে পাহাড় থেকে তোড়ে নেমে আসছে জলস্রোত। তার সঙ্গে মিশে আছড়ে পড়ছে বরফ আর পাথরের চাঁই। ভগবানকে ডাকছিলাম। ভাবছিলাম, গৌরীগাঁও-ও হয়তো চলে যাবে জলের গ্রাসে।” |
সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ বর্ধমান স্টেশনে দাঁড়িয়েও সবিতাদেবীর মনে পড়ে, “তখন গৌরীগাঁওয়ে কয়েকশো পর্যটক আশ্রয় নিয়েছেন। খাবার নেই। জল, বিস্কুটের ছোট্ট প্যাকেট, সব কিছুরই দাম ৩০ থেকে ৫০টাকা। এক বাড়ির মালিকের হাতে-পায়ে ধরে কিছু টাকা দিয়ে একটা ঘরে টানা দশ দিন থাকি। শেষে আমাদের খুঁজে বের করলেন মদন মিত্রেরা। ওঁদের জন্যই বিনা পয়সায় হরিদ্বারে, তার পরে ট্রেনে ফেরার সুযোগ পেয়েছি।” চোখের সামনে পাহাড় থেকে নেমে আসা বড়-বড় চাঁইয়ের তলায় কত নাম না জানা মানুষকে চাপা পড়ে যেতে দেখেছেন শুভাশিস। দেখেছেন, সেনা জওয়ানেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন লাশ বেলচায় করে তুলে দিচ্ছেন ট্রাকে। বলেন, “ভেবেছিলাম, পাথরের নীচে চাপা পড়ে মরিনি, কিন্তু অনাহারেই মারা যাব। শেষে যে বেঁচে ফের বাড়িতে ফিরতে পারব, তার জন্য ভাগ্য আর রাজ্য সরকারের উদ্যোগকে ধন্যবাদ।” আসানসোল যে দু’জন নেমেছেন, সেই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় ও দুলাল দাসের বাড়ি কুলটিতে। দু’জনেই ইসিএলের কর্মী। ১৬ জুন থেকে তাঁরা উত্তরাখন্ডের বরকোটে জলবন্দি ছিলেন। তাঁদের পৌঁছনোর খবর পেয়েই বহু মানুষ ইসিএল আবাসনে গিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছেন। বাড়ির লোকের ধড়েও প্রাণ ফিরেছে। আপাতত বেশ খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে তাঁরা ভয়াবহ স্মৃতি আর ক্লান্তি কাটিয়ে উঠতে চান।
বারাবনির বড়ডাঙা এলাকা থেকে যাওয়া তিন পর্যটকের কিন্তু এখনও কোনও খোঁজ নেই। তাঁদের পরিবারের সদস্য কল্যাণ মণ্ডল জানান, দিন সাত আগে পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছিল। তার পর থেকেই যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। বাড়ির লোকজন খুবই চিন্তায় রয়েছেন। তবে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও মনের জোর আর পাহাড়ের প্রতি টান হারাননি অনেকে। রামকৃষ্ণবাবু যেমন প্রথম সুযোগেই ফের কেদার-বদ্রীর পথে যেতে চান। তাঁর কথায়, “ওই তীর্থটা যে এ বার দর্শন করা হল না! এই আক্ষেপ নিয়ে মরতে চাই না।” |