মমতার রক্ষীরা সে দিন কোথায় ছিলেন
ছর চারেক আগের কথা। রোজকার মতো সন্ধের পরে সবে বাড়ির পথ ধরেছে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়। মহাকরণ ছাড়িয়ে ডান দিকে ঘোরার মুখে আচমকাই অন্য একটা সরকারি গাড়ি ঢুকে পড়ে ওই কনভয়ে। সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি জিপ কনভয়ে ঢুকে পড়া গাড়িটিকে আড়াল করে ডান দিকে ঠেলতে ঠেলতে বিবাদী বাগ বাসস্ট্যান্ডের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। এগিয়ে যায় বুদ্ধদেববাবুর কনভয়। পরে জানা যায়, গাড়িটি পূর্ব মেদিনীপুরের এক জন মহকুমা শাসকের। তিনি ছিলেনও গাড়িতে। ১০ মিনিট পরেই অবশ্য মহকুমা শাসকের গাড়ি ছেড়ে দেয় মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বাহিনী।
বছর আড়াই আগে এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল কোলাঘাটে, তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়ে। পূর্ব মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় ফেরার পথে কোলাঘাট সেতুর ঠিক আগে উল্টো দিক থেকে আসা একটি লরি কনভয়ে ঢুকে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে আড়াল করে মমতার গাড়িকে নিরাপদে বের করে আনেন নিরাপত্তারক্ষীরা।
এমন উদাহরণ আরও আছে। আসলে এ ভাবেই যে কোনও পরিস্থিতিতে জেড প্লাস মানের সুরক্ষা পাওয়া ভিআইপি-কে নিরাপত্তার পাশাপাশি তাঁর জন্য নিরাপদ রাস্তা বা ‘সেফ প্যাসেজ’ তৈরি করাই নিরাপত্তা বাহিনীর মূল কাজ। এবং তাঁদের এটারই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যারা সেই প্রশিক্ষণ দেন এবং যাঁরা তা পান দু’পক্ষই সে কথা জানাচ্ছেন। একই মত পুলিশকর্তাদেরও। সমাজবাদী পার্টির প্রধান মুলায়ম সিংহ যাদব কিংবা বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহের মতো তাবড় নেতাদের দেহ-রক্ষার দায়িত্বে থাকা ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ড (এনএসজি)-এ কাজ করে আসা এ রাজ্যের এক পুলিশ অফিসার বলেন, “যেমনই পরিস্থিতি তৈরি হোক না কেন, কোনও অবস্থাতেই তাঁরা যেন ভিআইপিকে ছেড়ে না দেন, প্রশিক্ষণের সময় এই বিষয়টা নিরাপত্তারক্ষীদের পাখি পড়ার মতো করে শেখানো হয়। এর ফলে তাঁদের মানসিক দৃঢ়তা এতটাই উচ্চ মাত্রায় বাঁধা থাকে যে, হাজারো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দেহরক্ষীরা ভিআইপিকে ছেড়ে রাখেন না।”
কামদুনি যাওয়ার পথে সে দিন নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে এ ভাবেই মোটরবাইকে সওয়ার মমতা।
তবে মঙ্গলবার তাঁর কামদুনি সফরের সময় এমনটা যে হয়নি, তা নিজেই বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার তিনি বলেছেন, “আমি কামদুনি থেকে বেরিয়ে চলে এসেছি। আমার সিকিওরিটিরা আমাকে বলছে, ‘দিদি, আপনি কি জানেন, আপনার কাছে একটাও সিকিওরিটি ছিল না? দু’ঘণ্টার জন্য আপনি একদম একা হয়ে গিয়েছিলেন! আপনি যে কোনও সময় মার্ডার হয়ে যেতে পারতেন’।”
তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর জেড প্লাস নিরাপত্তা বলয়ে থাকা রক্ষীরা সে দিন কী করছিলেন, প্রশ্ন উঠেছে মহাকরণে। ভিআইপিকে ঘিরে রাখাই যাঁদের কাজ, কামদুনিতে মুখ্যমন্ত্রীকে ফেলে তাঁরা কোথায় চলে গিয়েছিলেন, উঠেছে সেই প্রশ্নও। তা হলে কি কর্তব্যে গাফিলতি হয়েছিল তাঁদের?
মুখ্যমন্ত্রীর কথামতো যেখানে নিরাপত্তাকর্মীরাই সে কথা কবুল করেছেন, তা হলে কি তাঁদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ এনে বিভাগীয় তদন্ত করবে রাজ্য প্রশাসন? ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরে, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার অন্তত এর কোনও জবাব মেলেনি মহাকরণে। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রসচিব ও রাজ্য পুলিশের ডিজি-র সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁদের পাওয়া যায়নি। রাজ্যের নিরাপত্তা অধিকর্তা বীরেন্দ্র পুরো বিষয়টি শোনার পরে মোবাইল কেটে দেন। তার পর আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তা পরে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী এ সব কথা জনসভায় বলেছেন। আমাদের তো কিছু বলেননি।”
টানা ন’বছর এনএসজি-তে ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডো হিসেবে চাকরি করেছেন কল্যাণীর দীপাঞ্জন চক্রবর্তী। আপাতত মুম্বইয়ে একটি বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষী সংস্থার উচ্চপদে রয়েছেন। কংগ্রেস নেতা মনিন্দর সিংহ বিট্টা, অর্জুন সিংহ কিংবা বিজেপি-র লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো অনেক ভিআইপি-র নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। দীপাঞ্জনবাবু বলেন, “জেড প্লাস মানের নিরাপত্তা যাঁরা পান, সর্বদাই তাঁদের গায়ে লেগে থাকেন নিরাপত্তারক্ষীরা। একে ‘ক্লোজ প্রোটেকশন জোন’ বলা হয়। মানুষ ভিআইপিকে ফুল দিতে চাইলে বা হাত মেলাতে চাইলে ওই ‘জোন’-এর বাইরেই থাকতে হবে তাঁদের। নিরাপত্তা বেষ্টনী কেউ ভাঙতে পারবেন না।”
দীপাঞ্জনবাবুর মতে, ওই দিন নিরাপত্তার ব্যাকরণ মানেননি মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। গাড়ি ছেড়ে মোটরসাইকেলে চেপে, তা-ও আবার হেলমেটহীন অবস্থায় যাওয়া কখনওই উচিত হয়নি তাঁর। সেই সময় কেউ যদি তাঁকে আক্রমণ করত, তা হলে কিছুই করার থাকত না নিরাপত্তাকর্মীদের। রাজ্যের একাধিক পুলিশকর্তা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী আগেও এ ভাবে দলীয় কর্মীর মোটরসাইকেলে উঠে বসেছেন। ‘জেড প্লাস’ মানের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে একাধিক বার মোটরসাইকেলে চেপেছেন বুদ্ধদেববাবুও। রাজনৈতিক নেতাদের এ হেন আচরণ যে আদতে পুলিশেরই দুশ্চিন্তা বাড়ে, তা মানছেন রাজ্য প্রশাসনের কর্তারাও।
কামদুনি থেকে ফেরার পথে টুম্পার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর কথার সেই মুহূর্ত।
তখনও মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে রয়েছেন তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা রক্ষীরাই।
কেমন পুলিশি বন্দোবস্ত থাকে সুরক্ষার সর্বোচ্চ মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায়? এক পুলিশকর্তা বলেন, “ভিআইপি-র সঙ্গে সব সময়ের জন্য থাকেন দু’জন দেহরক্ষী (পার্সোনাল সিকিওরিটি অফিসার, সংক্ষেপে পিএসও), আগে-পিছে এসকর্ট কার এবং অবশ্যই বুলেট-রোধী গাড়ি। সব মিলিয়ে কম পক্ষে ১০-১২ জন নিরাপত্তা রক্ষী দিয়ে সাজানো হয় তাঁর নিরাপত্তা বলয়। এর বেশিও থাকতে পারে।”
রাজ্যের একাধিক পুলিশকর্তা বলেন, “সাধারণ ভাবে ‘জেড প্লাস’ নিরাপত্তা বলয় তিন স্তরে সাজানো হয়। বেগতিক পরিস্থিতিতে তারা পৃথক পৃথক ভাবে কাজ করলেও মূল লক্ষ্য কিন্তু ভিআইপি-র দেহ রক্ষা।” কী ভাবে কাজ করে নিরাপত্তা বলয়? ওই পুলিশকর্তা জানান, ভিআইপি আচমকা কোথাও বিক্ষোভের মুখে পড়লে তৃতীয় বৃত্তের (থার্ড রিং) নিরাপত্তা কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভিআইপি-র কাছাকাছি যাতে বিক্ষোভকারীরা ঘেঁষতে না পারে, সেটা দেখাই তখন তাঁদের এক মাত্র কাজ। ওই পুলিশকর্তা বলেন, “প্রয়োজনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা চালিয়ে যাওয়ারও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নিরাপত্তা রক্ষীদের। যাতে সেই ফাঁকে ভিআইপিকে বিক্ষোভস্থল থেকে বার করার ছক কষে নিতে পারেন নিরাপত্তা বলয়ের দ্বিতীয় বৃত্ত (সেকেন্ড রিং)। সেই ছক মতো ভিআইপিকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেওয়ার মূল দায়িত্ব প্রথম বৃত্তের (ফার্স্ট রিং), যাঁরা সব সময় তাঁর গা ঘেঁষে ডিউটি করেন।
নিরাপত্তার সেই ব্যাকরণ কি মানা হয়নি কামদুনিতে? গাফিলতি কার? উত্তর দেয়নি মহাকরণ।

—নিজস্ব চিত্র

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.