|
|
|
|
মৃত অন্তত ৪৬ |
লাগামছাড়া বৃষ্টি, বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ড-হিমাচল |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
নির্ধারিত সময়ের বেশ কয়েক দিন আগেই ঢুকে পড়েছিল বর্ষা। আর সেই আগাম বর্ষাই বিপর্যয় ডেকে আনল উত্তরাখণ্ড-হিমাচলের বিস্তীর্ণ এলাকায়।
তিন দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ড ও হিমাচলে সোমবার রাত পর্যন্ত অন্তত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। প্রশাসনের দাবি, এর মধ্যে ৩৭ জনই উত্তরাখণ্ডের। বাকিরা হিমাচল প্রদেশের। দুই জায়গাতেই অসংখ্য বাড়ি ধসে পড়েছে। খোঁজ মিলছে না বহু লোকের। নিখোঁজের সংখ্যাটা সঠিক ভাবে কেউই বলতে পারছেন না। দু’জায়গাতেই উদ্ধারকারী দল নামানো হয়েছে। তুলনায় ক্ষয়ক্ষতির হার অনেক বেশি উত্তরাখণ্ডে। বৃষ্টি, হড়পা বান আর ধসের ধাক্কায় সেখানে আটকে পড়েছেন কয়েক হাজার তীর্থযাত্রী। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে চার ধাম যাত্রা। আটকে পড়া তীর্থযাত্রীদের উদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে। বহু লোক নিখোঁজ। সরকারের তরফে প্রথমে ৫০ জন নিখোঁজ বলা হলেও উদ্ধারের কাজ যত এগোচ্ছে, সংখ্যাটা তত বাড়ছে। এই সংখ্যাটা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা প্রশাসনের।
|
|
বন্যার রোষ। হৃষীকেশে শিবের মূর্তির উপর আছড়ে পড়ছে জলোচ্ছ্বাস। |
দুর্যোগের শুরুটা হয়েছিল শনিবার থেকে। তার পর থেকে টানা তিন দিনের অবিরাম বৃষ্টি। আর তাতেই কোথাও ধস নেমেছে, কোথাও নদীর বিপদসীমার উপর দিয়ে বইতে শুরু করেছে। বহু জায়গাতেই ধস নেমেছে।
কেন এই অতিবৃষ্টি?
আবহবিদেরা জানান, আরবসাগরে তৈরি হওয়া একটি নিম্নচাপ শক্তিশালী হয়ে ওঠায় বর্ষা আগেভাগেই উত্তরাখণ্ড-হিমাচলের পাহাড়ে ঢুকেছে। পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত মেঘ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে থাকে
এবং তার আয়তন বাড়তে থাকে। এ ভাবে বাড়তে বাড়তে এক সময় গম্বুজ আকারের মেঘ তৈরি হয়।
এবং ভার ধরে রাখতে না পেরে এক সঙ্গে তা ভেঙে পড়ে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অতি-ভারী বৃষ্টিপাত হয়। সেই জল নদীর খাত বেয়ে নেমে আসার সময় তৈরি হয় হড়পা বান।
এ ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে।
আজ, মঙ্গলবারেও উত্তরাখণ্ডে অতি-ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলে মৌসম ভবন জানিয়েছে।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, অতিবৃষ্টির জেরে গঙ্গা-যমুনা এবং তাদের শাখা ও উপনদীগুলিতে হড়পা বান হয়েছে। অসিগঙ্গার জলে একটি চারতলা বাড়ি ও মন্দির ভেঙে পড়েছে। অলকানন্দার জলে গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের একটি অতিথিশালা ভেঙে পড়েছে। কেদারনাথের কাছে অন্তত ১০০টি ছোট-বড় বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হড়পা বানের তোড়ে গোবিন্দঘাটের গুরুদ্বারের সামনে রাখা কয়েকটি গাড়ি ভেসে গিয়েছে।
সরকারি সূত্রের খবর, এ দিনই উত্তরাখণ্ডে মন্দাকিনীর জল থেকে পাঁচ জনের দেহ মিলেছে। মালাকুনটির কাছে আটকে পড়া একটি অভিযাত্রী দলের সদস্য সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “নদী দিয়ে বহু ঘর-গেরস্থালির জিনিস ভেসে যেতে দেখলাম।” প্রশাসনের কর্তাদের দাবি, তড়িঘড়ি বর্ষা এসে যাওয়ায় নদীর জলবহন ক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ মেলেনি।
কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী যে দিকেই তাকানো হচ্ছে, শুধু ধ্বংসের ছবি। রবিবার রাত থেকেই উদ্ধারকাজ শুরু করেছে ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ (আইটিবিপি)। এ দিন আইটিবিপি-র মুখপাত্র দীপক পাণ্ডে জানান, ভারী বৃষ্টির কারণে ভেঙে গিয়েছে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ এবং গৌরীকুণ্ডের রাস্তা। ধস নেমেছে আরও কয়েকটি জায়গায়। সব থেকে খারাপ অবস্থা রুদ্রপ্রয়াগ জেলার। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির খবর মিলেছে উত্তরকাশী থেকেও। হরিদ্বার, হৃষিকেশ, দেরাদুনের বিস্তৃত এলাকা জলের তলায়।
সরকারি সূত্রের খবর, রাত পর্যন্ত রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় ২০ জনের মৃত্যুর সংবাদ মিলেছে। ভেঙে পড়েছে ৭০টির বেশি বাড়িঘর। মৃত্যুর খবর মিলেছে চামোলি, তেহরি, উত্তরকাশী ও দেরাদুনেও। আইটিবিপি-র মুখপাত্র জানিয়েছেন, উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ের একাধিক জায়গায় কয়েক হাজার মানুষ আটকে রয়েছেন। যাঁদের অধিকাংশই তীর্থযাত্রী। তীর্থযাত্রায় গিয়ে আটকে পড়েছেন ক্রিকেটার হরভজন সিংহ-ও। বৃষ্টি ও ধসের কারণে উত্তরাখণ্ডের বুদ্ধি-র কাছে কৈলাস-মানস সরোবর যাত্রীদেরও আটকে দেওয়া হয়েছে। |
|
উত্তরকাশীতে ভেসে যাচ্ছে ট্রাক ও বুলডোজার। সোমবার। |
আইটিবিপি সূত্রের খবর, রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় গাড়ি নিয়ে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। পায়ে হেঁটেই দুর্গতদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসা হচ্ছে। কম্যান্ডান্ট প্রবীণকুমার তিওয়ারির নেতৃত্বে বিপর্যয় মোকাবিলায় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল রবিবার রাত থেকে উদ্ধারের কাজ শুরু করলেও দফায় দফায় বৃষ্টিতে তা বারবার ভেস্তে যাচ্ছে। তবে ভোরের দিকে গোবিন্দঘাট এবং পাণ্ডুকেশ্বর এলাকা থেকে হাজার খানেক মানুষকে উদ্ধার করা হয়। তাঁদের জোশীমঠের একটি গুরুদ্বার ও আইটিবিপি-র অফিসে রাখা হয়েছে বলে দীপক জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “জোশীমঠেই পুরোদস্তুর উদ্ধার ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। আটকে পড়া দুর্গতদের সেখানেই নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।” আইটিবিপি সূত্রের খবর, রাতের দিকে বৃষ্টির জোর বেড়েছে। ধস নেমেছে জোশীমঠের আশপাশেও।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেরে উত্তরাখণ্ডে সব সরকারি কর্মীর ছুটি বাতিল করেছে সরকার। আইটিবিপির পাশাপাশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশনের কর্মীরাও উদ্ধারকাজে নেমেছেন। রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছেছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের ১২টি দল। গৌরীকুণ্ড, পাতালগঙ্গার পরিস্থিতিও সঙ্গীন বলে সরকার জানিয়েছে।
হিমাচলে অবশ্য সে ভাবে হড়পা বান ক্ষতি করেনি। সেখানে সমস্যা তৈরি করছে ধস। সরকারের এক মুখপাত্র জানান, কিন্নরে ধসের ফলে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে একই পরিবারের পাঁচ জন রয়েছেন। আটকে পড়েছেন দেশ-বিদেশের হাজার খানেক পর্যটক এবং দূরদর্শনের একটি দলও।
হিমাচল প্রদেশের মুখ্যসচিব সুদৃপ্ত রায় জানান, হিমাচলের পাহাড়ে দু’-তিন হাজার মানুষ আটকে রয়েছেন। কিন্নর এবং রামপুর ধস-বৃষ্টিতে রাজ্যের অন্যান্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংহ-ও মান্ডিতে দু’দিন ধরে আটকে রয়েছেন।
হিমাচল প্রদেশের সরকারি কর্তারা জানিয়েছেন, সেনা ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা উদ্ধারকাজে নামলেও বৃষ্টির তোড়ে তা বারেবারে ভেস্তে যাচ্ছে। কাজে লাগানো যাচ্ছে না হেলিকপ্টারও। সুদৃপ্তবাবু বলেন, “চারটি হেলিকপ্টার প্রস্তুত হয়ে আছে। কিন্তু বৃষ্টি না থামায় তা মান্ডি কিংবা সাংলা, কোথাও যেতে পারছে না।”
রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় সম্ভব হচ্ছে না সড়ক পথে উদ্ধারের কাজ-ও। হিমাচলপ্রদেশের অন্তত ২১টি জায়গায় ধস নেমেছে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্নরে সেনা নেমেছে উদ্ধারে।
দু’রাজ্যেই ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। সুদৃপ্তবাবু বলেন, “প্রচণ্ড বৃষ্টিতে উপর থেকে শতদ্রু নদীতে পাথর এসে পড়েছে। তার ফলে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। দু’দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই বিভিন্ন এলাকায়।” টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় উদ্বেগে রয়েছে পর্যটকদের পরিবারও। হোটেল, অতিথিশালাওকোনও জায়গাতেই ঠিক মতো ফোন করা যাচ্ছে না। উদ্ধারকারী দলগুলিও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতেও সমস্যায় পড়ছে।
পাহাড়ের প্রভাব পড়ছে সমতলেও। হরিয়ানায় যমুনা নদীর জলস্তর বেড়ে গিয়েছে। সে রাজ্যের সরকারি সূত্র জানিয়েছে, যমুনানগরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ১৫ জন শিশু-সহ ৫২ জন আটকে পড়েছেন। বন্যা সতর্কতা জারি করা হয়েছে কারনাল, পানিপথে। প্রবল বৃষ্টিতে ধস নেমে বন্ধ হয়ে গিয়েছে হরিদ্বার-দিল্লি হাইওয়েও। |
ছবি: এএফপি |
এই সংক্রান্ত আরও খবর |
• আগাম বর্ষাই ভেস্তে দিল বাঙালির ভ্রমণ |
• উত্তরকাশীতে ধসে আটকে বাঁকুড়ার ২৭ পর্যটক, উদ্বেগ |
পুরনো খবর: বাংলার বৃষ্টি-ভাগ্যে আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে আগাম বর্ষা উত্তর ভারতে |
|
|
|
|
|