মনোনয়ন প্রত্যাহার করে ফেরার পথে পা যেন চলছিল না বৃদ্ধের। ঝড়ঝাপটার দিন দেখা চোখগুলোয় ক্ষোভ, রাগ, হতাশা আরও কত কী। দলীয় সহকর্মীদের সান্ত্বনা, সহানুভূতির হাতগুলো এড়িয়ে যেন গাড়িতে উঠে পড়তে পারলেই বাঁচেন চিত্ত গরাই।
পশ্চিম মেদিনীপুরে কেশপুরের এই নেতা দলের জন্মলগ্ন থেকে তৃণমূলের সঙ্গী। দীর্ঘদিন কেশপুর ব্লক সভাপতি ছিলেন। যখন কেশপুরে বাম-বিরোধীদের খুঁজে পাওয়া যেত না, তখনও চিত্তবাবুকে তৃণমূলের পতাকা আঁকড়ে থাকতে দেখেছেন এলাকাবাসী। বছর ছেষট্টির এই নেতা কেশপুর থেকে জেলা পরিষদ আসনে এ বার মনোনয়ন দিয়েছিলেন। শেষমেশ দলীয় প্রতীক জোটেনি। শেষ দিনে (মঙ্গলবার) মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। মেদিনীপুর সদর মহকুমাশাসকের দফতরের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর আক্ষেপ, “দলীয় নেতারাই প্রার্থী হতে বলেন। বলেছিলাম, প্রার্থী-তালিকা চূড়ান্ত না হলে দাঁড়াব না। কারণ, মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হলে অপমানিত হব। শেষ পর্যন্ত অপমানিতই হলাম। এই বয়সে কী এ সব ভাল লাগে!”
টিকিট না পেলেও দলের কাজেই ব্যস্ত থাকতে চান বলে জানিয়েছেন চিত্তবাবু। কেশপুরের ওই আসনে যিনি জেলা পরিষদের প্রার্থী হয়েছেন, সেই শেখ মইনুদ্দিনের বক্তব্য, “আমি চিত্তবাবুরও আগে থেকে বাম-বিরোধী রাজনীতি করি। তা ছাড়া, দলে অনেকের থেকে বেশি সময় দিই। তাই দল প্রার্থী করেছে।”
এ প্রসঙ্গে তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর প্রতিক্রিয়া, “আমি তো প্রার্থী বাছিনি। যাঁরা বেছেছেন, তাঁরা বলতে পারবেন।” আর তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেছেন, “পুরনো ও নতুন তৃণমূলের কোনও দ্বন্দ্ব নেই। জেলা স্তর থেকেই প্রার্থীদের নাম এসেছিল। শীর্ষ নেতৃত্ব কিছু চাপিয়ে দেননি। সর্বত্র যোগ্য প্রার্থীকেই বাছা হয়েছে।” |
ভোটের আগে পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরে টিকিট কে পাবেন, শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলায় জেলায় পুরনো, পোড়-খাওয়া নেতাদের একটা বড় অংশ হতাশা লুকোচ্ছেন না। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই টিকিট-ভাগ্য শিকে ছিঁড়েছে তুলনায় নবীন নেতাদের। যাঁরা অনেক পরে অন্য দল থেকে তৃণমূলে এসেছেন।
প্রার্থী বাছাই নিয়ে এমনই উষ্মার ইঙ্গিত ঘাটালের আজবনগরে গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে। মনোনয়ন দিয়েও সেখানে দলের প্রতীক পাননি তৃণমূলের আজবনগর অঞ্চল সভাপতি ষাটোর্ধ্ব আনন্দ পাল। তাঁর বদলে প্রার্থী হয়েছেন বিধায়ক শঙ্কর দলুইয়ের ঘনিষ্ঠ বছর তিরিশের সৌমেন মাইতি। প্রবীণ আনন্দবাবুর আক্ষেপ, “সিপিএমের অত্যাচার সহ্য করে এলাকায় দলের কাজ করতাম। সেই আমাকেও মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হল!” শঙ্করবাবুর দাবি, শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সৌমেন প্রার্থী হয়েছেন।
একই ধরনের দ্বন্দ্বের হাড্ডাহাড্ডি রূপ দেখা গিয়েছে দাঁতনে, পঞ্চায়েত সমিতির একটি আসনে। এখানে লড়াই ছিল দলের জন্মলগ্ন থেকে তৃণমূলের দাঁতন-১ ব্লক সভাপতি বিক্রম প্রধানের মনোনীত প্রার্থী জার্মান সাহার সঙ্গে তুলনায় দলে নতুন কর্মী গৌতম প্রামাণিকের। ২০০৮-এর ভোটে ওই আসন থেকেই জয়ী গৌতমবাবু এ বারও মনোনয়ন দেন। আর ব্লক নেতৃত্বের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেন জার্মান। বিক্রমবাবুর উষ্মা, “গত নির্বাচনের পর থেকে উনি (গৌতম) মানুষের সঙ্গে সম্পর্কই রাখেননি।”
সাধারণত একটি আসনে একাধিক লোক মনোনয়ন দিলেও হিসেবমতো এক জনেরই দলীয় প্রতীক পাওয়ার কথা। কিন্তু দাঁতনের এই আসনে দু’জনই প্রতীক পেয়েছিলেন। নিয়মানুসারে, এমন পরিস্থিতিতে যিনি আগে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, তিনিই প্রার্থী হবেন। সেই মতো কার্যত ফোটো-ফিনিশে এই আসনে তৃণমূল প্রার্থী হয়েছেন জার্মান। আর তাতে চটেছেন গৌতমবাবু। বলেন, “নির্দল হয়ে ভোটে দাঁড়াচ্ছি।”
বাঁকুড়ায় জেলা পরিষদের ৪০ নম্বর আসনে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূলের সিহড় অঞ্চল কমিটির সম্পাদক তথা পুরনো নেতা বাসুদেব মুখোপাধ্যায়। ওই আসনে জনসাধারণের কমিটির নেতা হিসেবে জেল খাটা প্রবীর গরাইকে তৃণমূল প্রার্থী করেছে। বাম-জমানায় রাজনৈতিক মামলায় জড়িয়ে জেল খাটা বাসুদেবের বক্তব্য, “বামেদের সঙ্গে যুঝলাম আমরা। এখন প্রাক্তন মাওবাদী নেতাকে জেলা পরিষদের প্রার্থী করল দল!”
আত্মসমর্পণকারী মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতোর স্বামী প্রবীরবাবুর ২০১১ ভোটের পরে দলে যোগ দেওয়ায় এবং কোতুলপুর ব্লক সভাপতি হওয়ায় তৃণমূলের অন্দরে আলোড়ন পড়ে। এক প্রবীণ নেতার কথায়, “মাওবাদীদের সহযোগী সংগঠনের নেতা হিসেবে যিনি ধরা পড়েছিলেন, তাঁকে জেলা পরিষদে প্রার্থী করায় বিদ্রোহ তো হবেই।” প্রবীরবাবু অবশ্য এ সবে আমল দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, “মানুষ মা-মাটি-মানুষের প্রার্থীকেই জেতাবেন।” তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা কো-চেয়ারম্যান অরূপ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, বাসুদেববাবুর বিরুদ্ধে দল কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
|