মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন
প্রার্থী হতে না পেরে কেউ হতাশ, কেউ বা ফুঁসছেন
সাঁ করে মোটরবাইক ঢুকে পড়ল বিডিও অফিসে। আরোহী তিন জন। বাইক থামিয়ে নিমেষে তাঁরা ঢুকে পড়লেন অ্যাসিস্ট্যান্ট পঞ্চায়েত রিটার্নিং অফিসারের ঘরে। মনোনয়ন প্রত্যাহার করছেন নাকি? প্রার্থী নিরুত্তর। তবে সঙ্গী যুবকের ঝটিতি জবাব, “আমাদের তৃণমূলের একাধিক প্রার্থী ছিল তো। ইনি ‘ডামি’ প্রার্থী। তাই মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে এসেছেন।”
সোমবার, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে এমনই টুকরো টুকরো দৃশ্য দেখা গেল পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন ব্লক অফিস ও মহকুমাশাসকের দফতরে। কোথাও মন খারাপ, কোথাও ক্ষোভ, কোথাও বা দেখে নেওয়ার হুঁশিয়ারি। এ দিন যাঁরা মনোনয়ন তুললেন, তাঁদের অধিকাংশ তৃণমূল প্রার্থী। প্রধান দুই বিরোধী দল সিপিএম এবং কংগ্রেসের প্রার্থীদের শেষ দিনে বিশেষ মনোনয়ন তুলে নিতে দেখা যায়নি। তবে কিছু সিপিআই প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে দেখা যায়। অভিযোগ, এই সব বাম প্রার্থীকে ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করেছে তৃণমূল। সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক সন্তোষ রাণার অভিযোগ, “আমাদের প্রার্থীদের মেরে ধরে মোটরবাইকে চাপিয়ে নিয়ে গিয়ে মনোনয়ন প্রহ্যাতার করতে বাধ্য করা হচ্ছে।” অভিযোগ উড়িয়ে জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোৎ ঘোষের বক্তব্য, “আমরা কাউকে জোর করিনি। যাঁরা হারবেন বুঝে গিয়েছেন, তাঁরা নিজেরাই মনোনয়ন প্রত্যাহার করছেন।”
শেষ লগ্নে: দফতরের সামনে ছিল পুলিশি পাহারা। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
এ দিন যাঁরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেন, তাঁদের সকলের মুখভার, মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতোই। জেলা পরিষদ থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত, ত্রিস্তরেই বহু আসনে একাধিক তৃণমূল প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিলেন। একজনকে দল প্রতীক দিয়েছে। বাকিদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হয়েছে দলীয় নির্দেশে। অনেকে নির্দেশ মেনেছেন, অনেকে মানেননি। যাঁরা মেনেছেন, তাঁদের অনেকেই হতাশ। যেমন, কেশপুর থেকে জেলা পরিষদ আসনে মনোনয়ন দেওয়া তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি চিত্ত গরাই, জেলা নেতা শেখ ইমদাদুল ইসলাম ও মীর আরশেদ আলি এ দিন মহকুমাশাসকের অফিসে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। হতাশ গলায় ইমদাদুল বললেন, “কী আর করব। দলের সিদ্ধান্ত তো মানতেই হবে।” প্রবীণ নেতা চিত্তবাবু তো একেবারে মর্মাহত। আক্ষেপ, “পার্টির জন্মলগ্ন থেকে রয়েছি। আগেই নেতাদের বলেছিলাম, আমি মনোনয়ন দেব না। তখন সকলে বলল, দিন না, দেখা যাবে। জানতাম আমার মতো বয়স্ক মানুষের কাছে মনোনয়ন প্রত্যাহারটা খুব বেদনার হবে। শেষ পর্যন্ত সেই দুঃখটাই পেতে হল।” চিত্তবাবুর আসনটিতে দলীয় প্রতীক পেয়েছেন মইনুদ্দিন। ইনিও তৃণমূলের কেশপুর ব্লক সভাপতি ছিলেন। তবে মাত্র দু’মাসের জন্য। তাঁর বক্তব্য, “আমি চিত্তবাবুর থেকেও পুরনো কর্মী। সে জন্যই দল আমাকে বেছেছে। তাছাড়া ওদের থেকে দলকে আমি অনেক বেশি সময় দিই।”
এক একটি আসনে একাধিক ব্যক্তি মনোনয়ন দেওয়ায় দিনভর উদ্বিগ্ন ছিলেন তৃণমূল নেতৃত্বও। সংশয় ছিল দলীয় নির্দেশ মেনে সকলে মনোনয়ন প্রত্যাহার করবেন কিনা। ঝাড়গ্রামের এক প্রবীণ তৃণমূল নেতা তো বলেই ফেললেন, “এ যেন কন্যাদায়। বিকেল তিনটে বাজলেই তো লগ্ন শেষ। তার আগে মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতেই হবে।” বেলা ১২টা নাগাদ একই গাড়িতে এলেন গোপীবল্লভপুর ১ ব্লকের দুই নেতা লোকেশ কর ও সিংরাই মুর্মু। প্রাক্তন ছাত্রনেতা লোকেশ ব্লকের ৭ নম্বর জেলা পরিষদ আসনে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। আর ব্লক তৃণমূল সভাপতি সিংরাইবাবু মনোনয়ন দিয়েছিলেন ৮ নম্বর জেলা পরিষদ আসনে। দলের একাংশ লোকেশ-সিংরাইকে চাইলেও ওই দু’টি আসনে নয়াগ্রামের বিধায়ক দুলাল মুর্মুর ‘স্নেহধন্য’ দুই প্রার্থীকে দলীয় প্রতীক দেওয়া হয়। মনোনয়ন প্রত্যাহার করে শুকনো মুখে ফেরার পথে লোকেশ বললেন, “দলের সিদ্ধান্ত মেনে মনোনয়ন প্রত্যাহার করলাম।” কাছেই ছিলেন তাঁর আসনে দলীয় প্রতীক পাওয়া প্রার্থী দিলীপ ঘোষ। দিলীপবাবুকে বলতে শোনা গেল, “শরীরটা এ বার বেশ জুত লাগছে। একটু চা খেলে হয়।”
একে একে প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করছেন, আর জেলা সাধারণ সম্পাদক দুর্গেশ মল্লদেব, বিধায়ক চূড়ামণি মাহাতোদের হাসি চওড়া হচ্ছে। ঝাড়গ্রাম ব্লকের ১৩ নম্বর আসনে তৃণমূলের প্রতীক পেয়েছেন মন্ত্রী সুকুমার হাঁসদার ঘনিষ্ঠ তপন বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই আসনে দলের ঝাড়গ্রাম ব্লক সভাপতি অনিল মণ্ডলও প্রার্থী হয়েছিলেন। আড়াইটে নাগাদ বর্ষীয়ান অনিলবাবু ব্যাজার মুখে মনোনয়ন প্রত্যাহার করার পর বললেন, “দলের স্বার্থেই মনোনয়ন প্রত্যাহার করলাম।”
ঘড়িতে তিনটে বাজতে পাঁচ। মাইক্রোফোনে মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক কুশল চক্রবর্তী বার বার ঘোষণা করছেন, “আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। যাঁরা স্বেচ্ছায় মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে চান, চলে আসুন।” হঠাৎ-ই বিধায়ক চূড়ামণি মাহাতো দুই প্রার্থীকে বগলদাবা করে ছুটলেন রির্টানিং অফিসারের ঘরে। গোপীবল্লভপুর-১ ব্লকের সাত নম্বর জেলা পরিষদ আসনে দলের বিক্ষুব্ধ প্রার্থী মুরলিধর ঘোষ ও ঝাড়গ্রাম ব্লকের তেরো নম্বর জেলা পরিষদ আসনের বিক্ষুব্ধ প্রার্থী অংশুমান গিরির মনোনয়ন প্রত্যাহার করানোর পর দৃশ্যতই উৎফুল্ল চূড়ামণিবাবুর মন্তব্য, “আর একটু দেরি হলেই কেলেঙ্কারি হত।”
দলীয় নির্দেশ মেনে মনোনয়ন তুললেন না, তৃণমূলের এমন প্রার্থীরও দেখা মিলল। তাঁরা লড়বেন নির্দল হয়ে। আনন্দপুরের আশিস রায় এ দিন মেদিনীপুর সদর মহকুমাশাসকের দফতরে দাঁড়িয়ে তৃণমূল নেতাদের সামনেই সাফ জানিয়ে দিলেন, “১৯৯৮ সালে আমার স্ত্রী পঞ্চায়েত থেকে দাঁড়িয়ে সিপিএমের কাছে মার খেয়েছিল। কত অত্যাচারিত হয়েছি। তখন নেতারা কোথায় ছিল। এখন আমি প্রার্থী হওয়ায় দল বলছে টিকিট দেবে না। আমি মনোনয়ন প্রত্যাহার করব না। নির্দল হয়েই লড়াই করব।” বেলপাহাড়ি ব্লকের ৬৪ নম্বর জেলা পরিষদ আসনে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল প্রার্থী অমৃত সরেনও মনোনয়ন তোলেননি। মোটর গাড়ি প্রতীকে নির্দল হিসেবে লড়বেন তিনি। ঘাটালের আজবনগরের তৃণমূল অঞ্চল সভাপতি আনন্দ পাল আবার মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও রীতিমতো ক্ষুব্ধ। প্রকাশ্যেই বলছেন, “দল বলেছে বলে মনোনয়ন তুলে নিলাম। তবে আমি ক্ষুব্ধ।” গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে মনোনয়ন দিয়েছিলেন আনন্দবাবু। এই আসনে দল টিকিট দিয়েছে সৌমেন মাইতিকে। সৌমেনবাবু বলছেন, “প্রার্থী হতে না পারলে কষ্ট তো হবেই।” মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে জেলা জুড়ে দেখা গেল অনুভূতির এমনই বৈচিত্র। সব থেকে মর্মাহত তাঁরা, যাঁরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, অথচ দলীয় নেতাদের কথায় প্রার্থী হয়েছিলেন। শালবনির গড়মাল থেকে তৃণমূলের হয়ে মনোনয়ন দেওয়া এমনই এক গৃহবধূ এ দিন মহকুমাশাসকের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। স্বামীর সঙ্গে মোটরবাইকে করে এসেছেন তিনি। ম্লান মুখে মনোকষ্ট স্পষ্ট। নাম জানাতে চাইলেন না। শুধু বললেন, “প্রার্থী তো হতে চাইনি। ওরাই করল। আবার প্রত্যাহারও করাচ্ছে!” মাথা নীচু করে ভেতরে ঢুকলেন মহিলা। শুধু কষ্ট নয়, মাথা হেঁট বোধহয় লজ্জাতেও।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.