শাসন, গড়বেতা, খানাকুল শাসক দলের বিরুদ্ধে গা-জোয়ারির অভিযোগ যে সব জায়গায় বাম আমলে উঠত, তৃণমূল জমানাতেও উঠছে। পঞ্চায়েত ভোটের প্রথম পর্বের মনোনয়ন তোলা এবং জমা দেওয়ার পাট মিটতেই জেলা এবং রাজ্য স্তরের সিপিএম নেতারা দাবি করতে শুরু করেছেন, তৃণমূলের সন্ত্রাসে শাসন, গড়বেতা, খানাকুল-সহ রাজ্যের অনেক জায়গাতেই তাঁদের লোকেরা মনোনয়ন তুলতে বা জমা দিতে পারেননি। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের নেতারা। তৃণমূলের প্রতিপাদ্য সিপিএম প্রার্থী পাচ্ছে না।
বিরোধীদের তোলা সন্ত্রাসের অভিযোগ নস্যাৎ করে বুধবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “সিপিএম সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন জমা দিয়েছে। আমার হিসেবে, ওদের সময়ে গত পঞ্চায়েতে ১৮০ জন খুন হয়েছেন। ওরা সব তথ্য রেকর্ড করে না। ওরা আবার এখন কী বলছে!”
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “নানা বাধা-বিপত্তি-সন্ত্রাসের মধ্যেই বাম-প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিচ্ছেন। নিরাপত্তার দাবি শুধু আমাদের জন্য নয়। তৃণমূলের হাত থেকে তৃণমূলেরই সব লোককে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা মুখ্যমন্ত্রীর নেই। তৃণমূল যাতে সব আসনে মনোনয়ন জমা দিতে পারে, জন্যও কেন্দ্রীয় বাহিনী দরকার।”
সিপিএমের দাবি, খানাকুলের ১ এবং ২ ব্লকে পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদের একটি আসনেও প্রার্থী দিতে পারেনি তারা। দু’টি ব্লক মিলিয়ে ৩৩৭টি পঞ্চায়েত, ৭০টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ৬টি জেলা পরিষদ আসন রয়েছে।
গত পঞ্চায়েত ভোটেও খানাকুল ছিল কার্যত বিরোধী-শূন্য। এখন সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলছেন, “আমাদের দলের প্রার্থীরা মনোনয়ন তুলতে বা জমা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। তবে ব্লক অফিস ওরা (তৃণমূল) ঘিরে রেখেছিল। আরামবাগে মহকুমাশাসকের অফিসে আসার রাস্তাতেও ওরা জমায়েত রেখেছিল। আমাদের প্রার্থীরা আতঙ্কে সেখানে পৌঁছতেই পারেননি।” যদিও খানাকুলের বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা শৈলেন সিংহ বলেন, “গোঘাট থেকে বহু সিপিএম প্রার্থী আরামবাগে এসডিও অফিসে গিয়ে মনোনয়ন জমা দিলেন, আর খানাকুল থেকে পারলেন না? পুলিশের কাছে ক’টা অভিযোগই বা ওরা (সিপিএম) জমা করেছে?”
জেলা পুলিশকর্তারাও দাবি করেছেন, খানাকুলের সর্বত্র পর্যাপ্ত পুলিশি ব্যবস্থা ছিল। পথে কোনও রাজনৈতিক দলের জমায়েত ছিল না।
এক সময় দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা মজিদ মাস্টার প্রভাবিত উত্তর ২৪ পরগনার শাসন-খড়িবাড়ি এলাকায় পঞ্চায়েতে ১৩৫টির মধ্যে ২৯টি আসনে প্রার্থী নেই বামেদের। ওই এলাকার বারাসত ২ ব্লকে ২১টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে তিনটিতেও কোনও বাম প্রার্থী নেই।
স্থানীয় সিপিএম নেতা কুতুবউদ্দিন আহমেদের দাবি, “ওই আসনগুলিতে এ দিনও আমরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তৃণমূলের তাণ্ডবে তা আর হয়ে ওঠেনি।” তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক তথা মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “বাধা তো দূর, এ ক’দিন কোথাও এক মুহূর্তের জন্য কোনও গণ্ডগোল করতে দেওয়া হয়নি।” জ্যোতিপ্রিয়বাবুর সংযোজন, “শাসনে সন্ত্রাস শেষ। সিপিএম প্রার্থী পাবে কোথা থেকে?” সব মিলিয়ে উত্তর ২৪ পরগনায় ৩৭টি পঞ্চায়েত এবং চারটি পঞ্চায়েত সমিতি আসনে শাসক দলের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
২০০৮-এ গড়বেতা ১ এবং ৩ ব্লকে পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরের বহু আসনেই বিনা লড়াইয়ে জিতেছিলেন বামেরা। এ বার গড়বেতা ৩ ব্লকে পঞ্চায়েতের ১১৫টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫টিতে প্রার্থী দিয়েছে সিপিএম, ১টিতে সিপিআই। পঞ্চায়েত সমিতির ২১টি আসনে সিপিএমের প্রার্থী তিন জন, সিপিআইয়ের এক জন। গড়বেতা ১ ব্লকেও ছবিটা বিশেষ আলাদা নয়। গত বিধানসভা ভোটে রাজ্য জুড়ে দলের ভরাডুবির মধ্যেও গড়বেতা কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ। তিনি এখন বলছেন, “এলাকায় কোনও নেতা নেই। কী ভাবে প্রার্থী দেওয়া যাবে!”
পূর্ব মেদিনীপুরে খেজুরি ২ ব্লকে পঞ্চায়েত সমিতির ১৫টি আসনের মধ্যে ৯টিতে শুধু তৃণমূলেরই প্রার্থী রয়েছে। অর্থাৎ স্ক্রুটিনি পর্বে সব ঠিক থাকলে খেজুরি ২ পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূলের দখলে চলে যাচ্ছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রায় ৭০টি পঞ্চায়েত আসনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হচ্ছে না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে। বাঁকুড়ার জয়পুর ও কোতুলপুর ব্লকের পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির আসনগুলিতে প্রার্থী নেই বামেদের। কোতুলপুরে পঞ্চায়েত ১৪১টি, পঞ্চায়েতে সমিতিতে আসন ২৪টি। জয়পুরে পঞ্চায়েতে ১১৬টি, পঞ্চায়েতে সমিতিতে আসন ২৫টি। হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর ব্লকের ১৫৪টি পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে ১২৭টিতে, পঞ্চায়েত সমিতির ৩৩টির মধ্যে ২৫টিতে তৃণমূলের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বর্ধমানে পঞ্চায়েতে স্তরে ২৪৮টি এবং পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে ২৫টি আসনে শুধু তৃণমূলই মনোনয়ন দিয়েছে। এর মধ্যে একটা বড় অংশ কেতুগ্রামে এবং রায়নায়।
পূর্ব-পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি, বাঁকুড়া বা হাওড়াসর্বত্রই সিপিএম নেতারা প্রার্থী দিতে না পারার জন্য অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তৃণমূলের দিকে। একই সুর কংগ্রেস এবং বিজেপি-রও। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, “প্রথম পর্বে ন’টি জেলার ২১০টি ব্লকে যেখানে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে মাত্র ৭১টি ব্লকের ক্ষেত্রে মহকুমাশাসকের দফতরে মনোনয়ন তোলা বা জমা দেওয়ার নির্দেশ কেন দিল নির্বাচন কমিশন? সংখ্যাটা তো বাড়ানো যেতে পারত!” তবে কমিশন জানিয়েছে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ সন্ত্রাসের অভিযোগ ও পর্যবেক্ষকদের রিপোর্টের ভিত্তিতে।
|