|
|
|
|
শেষ হল মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর্ব |
অনেক আসনই বাম-শূন্য, উঠছে সন্ত্রাসের অভিযোগ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
একদা ‘লাল দুর্গে’ই এখন ‘বিপন্ন’ সিপিএম। মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে সেই ছবিই সামনে এল। গড়বেতা, কেশপুর থেকে চন্দ্রকোনা এক সময় সিপিএমের যে সব দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে দাঁত ফোটাতে পারত না বিরোধীরা, এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেই সব এলাকাতেই প্রার্থী দিতে পারছে না সিপিএম।
বুধবার ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। দেখা যাচ্ছে, কেশপুরে কিছু সংখ্যক আসনে প্রার্থী দিলেও গড়বেতা ১ ও ৩ ব্লক, চন্দ্রকোনা ১ ও ২ ব্লকে পঞ্চায়েতের অধিকাংশ আসনেই প্রার্থী দিতে পারেনি বামেরা। পরিসংখ্যান বলছে, গড়বেতা-১ ও গড়বেতা-৩ ব্লকে সিপিএম জেলা পরিষদ আসনে প্রার্থী দিলেও গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির অধিকাংশ আসনেই প্রার্থী দিতে পারেনি। অথচ গত বিধানসভা ভোটে রাজ্য জুড়ে ভরাডুবির মধ্যেও গড়বেতা কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ। এলাকায় দলের দুর্বলতা স্বীকার করছেন তিনিও। সুশান্তবাবুর কথায়, “এলাকায় কোনও নেতা নেই। কী ভাবে প্রার্থী দেওয়া যাবে।” দাসেরবাঁধ কঙ্কাল-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পর থেকে আদালতের নির্দেশে পশ্চিম মেদিনীপুরে রাত্রিবাস করতে পারেন না সুশান্তবাবু। এ বার ভোট প্রচারেও থাকছেন না তিনি। মঙ্গলবার মামলার শুনানি থাকায় মেদিনীপুর আদালতে এসেছিলেন সুশান্তবাবু। তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গড়বেতার বিধায়ক বলেন, “আইনজীবীদের পরামর্শ মেনেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য গড়বেতায় যাচ্ছি না। তবে দলীয় নেতৃত্বকে বলেছি বুঝেশুনে প্রার্থী দিতে।” তারপরেও প্রার্থী বিশেষ দেওয়া যায়নি। স্থানীয় এক সিপিএম নেতার কথায়, “প্রার্থী হওয়ার জন্য অনেকেই তৈরি ছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে? সে জন্যই প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” |
|
প্রার্থী ছাড়া মহকুমাশাসকের দফতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কাউকেই। |
২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গড়বেতা ১ ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৩৪টি, পঞ্চায়েত সমিতির ৩০টি ও জেলা পরিষদের ২টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল সিপিএম, পঞ্চায়েত সমিতির ২টি আসন ছিল সিপিআইয়ের দখলে। গড়বেতা ৩ ব্লকের ১০০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে সিপিআই ২টিতে ও ৭০টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল সিপিএম। পঞ্চায়েত সমিতির ১৯টি আসনের মধ্যে ১১টি আসন বিনা প্রতিন্দ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল তারা। আর এ বার ছবিটা একেবারে উল্টো। গড়বেতা ৩ ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের ১১৫টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫টিতে প্রার্থী দিয়েছে সিপিএম, ১টিতে সিপিআই। পঞ্চায়েত সমিতির ২১টি আসনে সিপিএমের প্রার্থী মাত্র ৩ জন, সিপিআইয়ের একজন।
এই পরিস্থিতির জন্য সিপিএম নেতৃত্ব শাসকদলের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাস’-এর অভিযোগ তুলছেন। দলের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের বক্তব্য, “এ কথা ঠিক আমরা বহু আসনে মনোনয়ন দিতে পারিনি। এর জন্য তৃণমূলের সন্ত্রাসই দায়ী।” তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কাযর্করী সভাপতি প্রদ্যোৎ ঘোষ অবশ্য দাবি করেন, “আমরা কোথাও বাধা দিইনি। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে সিপিএম খুন, সন্ত্রাসের যে জঘন্য রাজনীতি করেছে এখন তারই মাসুল দিচ্ছে। মানুষ আর ওদের সঙ্গে থাকতেই চাইছে না। তাই প্রাথীও খুঁজে পাচ্ছে না।”
গড়বেতার মতোই আর এক ‘লাল দুর্গ’ ছিল কেশপুর। সেখানেও সিপিএমের অবস্থা বেশ খারাপ। প্রথমে তো ব্লক অফিসে কেশপুরের প্রার্থীরা মনোনয়নই জমা দিতে পারেননি। সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠায় মহকুমাশাসকের অফিসে মনোনয়ন দিয়েছেন সিপিএম প্রার্থীরা। বুধবার মনোনয়ন শেষে দেখা যাচ্ছে, কেশপুর ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৩০টি আসনের মধ্যে মাত্র ২৩টিতে এবং পঞ্চায়েত সমিতির ৪৫টি আসনের মধ্যে মাত্র ৮টিতে প্রার্থী দিতে পেরেছে সিপিএম। কেশপুরের সিপিএম বিধায়ক রামেশ্বর দোলুইয়ের অভিযোগ, “এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। তার মধ্যেই কিছু মানুষ প্রার্থী হওয়ার সাহস দেখিয়েছেন।” তবে কী তাঁরা গ্রামে গিয়ে প্রচার করতে পারবেন, গ্রামে থাকতে পারবেন কিনা আশঙ্কা রয়েছে। রামেশ্বরবাবু বলেন, “পরিস্থিতি দেখে পদক্ষেপ করা হবে।” দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রার্থীদের উপর হামলা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে তাঁদের অন্যত্র রাখার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে সিপিএমের। |
|
এগরায় মহকুমাশাসকের দফতরে মনোনয়ন। |
চন্দ্রকোনা ১ ও ২ ব্লকে সিপিএম বিশেষ প্রার্থী দিতে পারেনি। চন্দ্রকোনা ১ ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০২টি আসনের মধ্যে সিপিএম প্রার্থী দিয়েছে ২৪টিতে। পঞ্চায়েত সমিতির ১৮টি আসনের মধ্যে সিপিএম প্রার্থী দিয়েছে মাত্র ৪টিতে। চন্দ্রকোনা ২ ব্লকেও সিপিএমের হাল বেশ খারাপ। গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮৬টি আসনের মধ্যে ১৫টিতে এবং পঞ্চায়েত সমিতির ১৬টি আসনের মধ্যে ৫টিতে প্রার্থী দিতে পেরেছে সিপিএম। অথচ এই দুই ব্লকেই এক সময় একাধিপত্য ছিল সিপিএমের। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চন্দ্রকোনা ২ ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের ৭৩টি আসনের মধ্যে ৭১টি, পঞ্চায়েত সমিতির ১৬টির মধ্যে ১৩টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতীয় জয়ী হয়েছিল সিপিএম। চন্দ্রকোনা ১ ব্লকেও গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮৮টি আসনের মধ্যে ৫৫টি ও পঞ্চায়েত সমিতির ১৬টি-র মধ্যে ৭টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল সিপিএম।
বেশ কিছু ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির অনেক আসনে প্রার্থী দিতে না পারলেও জেলা পরিষদের ৬৭টি আসনের সবকটিতেই মনোনয়ন দিয়েছেন বাম প্রার্থীরা। এ দিন তৃণমূল প্রার্থীরাও মনোনয়ন জমা দেন। এ দিন মনোনয়ন শেষে হিসেব বলছে, জেলা পরিষদের ৬৭টি আসনে তৃণমূল ১৫৭টি, সিপিএম ৭৭টি, সিপিআই ৬টি, ফরওয়ার্ড ব্লক ২টি, কংগ্রেস ৫১টি ও নির্দল প্রার্থীরা ৬৬টি আসনে মনোনয়ন দিয়েছেন।
লক্ষ্যণীয়, শুধু জেলা পরিষদ নয়, ত্রি-স্তরের অনেক আসনেই একাধিক তৃণমূল প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। কোন্দলের জেরেই এই পরিস্থিতি। আগামী শুক্রবার মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। তার আগে দলীয় নেতৃত্ব ক’জনকে বুঝিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে পারলেন, সেটাই এখন দেখার। না হলে অনেক আসনেই তৃণমূল বনাম তৃণমূল লড়াই হবে।
|
—নিজস্ব চিত্র। |
এই সংক্রান্ত আরও খবর
• সব আসনে প্রার্থী নেই বামফ্রন্টের
• বহু আসনে প্রার্থী নেই সিপিএমের
|
|
|
|
|
|