ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে হঠাৎ ক্ষীণ মহিলা কণ্ঠ!
ঘটনাস্থলে উপস্থিত উদ্ধারকর্মীরা হতবাক। মৃত্যুপুরীতে প্রাণের স্পন্দন, এ-ও কি সম্ভব? ১৭ দিন ধরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে তাঁরাই রানা প্লাজার কবর খুঁড়ে বার করে আনছেন একের পর এক নিথর দেহ। ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া বহুতলের ওই পোশাক কারখানার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ১৭ দিন পরেও যে কেউ জীবিত থাকতে পারেন, সে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তাঁরা।
রোজকার মতো এ দিনও উদ্ধারকাজ শুরু হয়েছিল পুরোদমে। দিনের শুরুতেই উদ্ধারকর্মীদের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর দিন দু’য়েকের মধ্যেই কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। পরিকল্পনা মাফিক চলছিল রানা প্লাজার বেসমেন্ট পরিষ্কারের কাজ। উদ্ধারকর্মী মেজর মোয়াজ্জেম জানান, ১৫ বছরের স্কুল পড়ুয়া এক স্বেচ্ছাসেবক প্রথম এসে তাঁদের খবর দেয়, নীচের তলায় কেউ বেঁচে আছেন! প্রথমে তার কথা বিশ্বাস করেননি উদ্ধারকর্মীরা। তবু বেসমেন্টের স্ল্যাবগুলো বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলার আগে তাঁরা চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “কেউ কি আছেন?”
সাড়া মেলে। উদ্ধারকর্মীদের কানে আসে এক মহিলার গোঙানি। ক্লান্তি আর অবসাদ মেশানো সেই কণ্ঠে তখনও বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রবল। ধীর গলায় মেয়েটি বলছেন, “আমি রেশমা। চিন্তা করবেন না, আমি খুব একটা আহত নই।” উপর থেকে উদ্ধারকর্মী দেখেন, আস্তে আস্তে হাত তুলে মহিলা জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে, তিনি বেঁচে।
দ্রুত পাল্টে গেল ছবিটা। দু’সপ্তাহ ধরে মূলত মৃতদেহ খুঁজেই যাঁরা কাটিয়েছেন, তাঁরাই এ বার মেতে উঠলেন মেয়েটিকে উদ্ধারের কাজে। বুলডোজার, ক্রেনের বদলে নিয়ে আসা হল ড্রিলিং মেশিন। বিকেল তিনটে কুড়ি নাগাদ শুরু হল অভিযান। ঘণ্টা খানেকের চেষ্টায় ভেঙে পড়া সিমেন্টের চাঁই সরিয়ে বার করে আনা সম্ভব হল রেশমাকে। বেগুনি জামা গায়ে রেশমাকে দেখতে সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ওই এলাকায় তখন ভিড় জমিয়েছেন অনেকেই। ভিড়ের মধ্যে ছিলেন রেশমার বোন আসমাও। বোনকে দেখে চিনতে পেরে তাঁর দিকে তাকিয়ে হাতও নাড়েন রেশমা। |
অল্প জল ও বিস্কুট খাইয়ে রেশমাকে তোলা হল অ্যাম্বুল্যান্সে। ক্লান্ত শরীর। বেশি দূর যাত্রার ধকল নিতে পারবেন না, এই আশঙ্কায় তাঁকে ভর্তি করা হয় সাভারেরই এক সামরিক হাসপাতালে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, রেশমা এখন মোটামুটি সুস্থ। শরীরে জল-শূন্যতা ও শ্বাসপ্রশ্বাসের কষ্ট ছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই। চিকিৎসকদের রেশমা জানিয়েছেন, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের বাসিন্দা তিনি। সাভারের ওই বহুতলে ‘নিউ ওয়েভ বটম’ পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। ঘটনার দিন রানা প্লাজার বেসমেন্টে নমাজ পড়ার জায়গায় কোনও ভাবে আটকে পড়েন। পুরো বাড়িটা ধসে পড়লেও ওই জায়গাটি অক্ষত ছিল। বদ্ধ পরিবেশে ১৭ দিন কাটালেও রেশমা সম্পূর্ণ অভুক্ত ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে কিছু শুকনো খাবার ছিল। দিন দু’য়েক আগে সেই খাবারও অবশ্য ফুরিয়ে যায়।
কতটা ভয়াবহ এই ১৭ দিনের অভিজ্ঞতা? হাসপাতালের শয্যা থেকেই সাংবাদিকদের রেশমা বলেন, “নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।...বাড়িটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার পরে অনেক কষ্টে লাঠি দিয়ে চাঁই সরিয়ে বেসমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিলাম। অনেক চিৎকার করেছি। কেউ শুনতে পায়নি।”
হাসপাতাল সূত্রের খবর, রেশমার খোঁজ নিতে চিকিৎসকদের ফোন করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। দিনের শেষে সাভারের ধ্বংসস্তূপ থেকে রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অভূতপূর্ব ঘটনা। রেশমাকে উদ্ধার করার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক, উদ্ধারকর্মী ও দমকল বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই।” তবে শুক্রবারের উদ্ধারকাজ শেষে আরও একশো জনের মৃতদেহ মিলেছে। এই নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১০৬০।
এত দিন বদ্ধ পরিবেশে প্রায় জল না খেয়ে কী করে কেউ বেঁচে থাকতে পারে? চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র বলেন, “যদি শরীর টানা অক্সিজেন আর জলের সরবরাহ পায় তা হলে ১৬-১৭ দিন এই ভাবে থাকতেই পারে। হয়তো শরীরে নিউট্রিশন কমে যাবে, শরীর দুর্বল হয়ে যাবে, রক্তচাপ অনেক কমবে, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু মানুষটি মারা না-ও যেতে পারে।” তবে সুব্রতবাবু সতর্ক করে দেন, “এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা অত্যন্ত ঝুঁকির। যে কোনও মুহূর্তে শরীরের কোনও অঙ্গ বিকল হতে পারে।”
চিকিৎসক কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যাতেও, অক্সিজেন আর জল পাওয়াটা হল সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৭ দিনের মধ্যে ১৫ দিন মেয়েটি জল আর বিস্কুট খেতে পেরেছিল। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য পেয়েছিল অক্সিজেন। জল না পেলে বাঁচা মুশকিল হত। কিডনির সমস্যা তৈরি হতে পারত। বিস্কুট থেকে কিছুটা কার্বোহাইড্রেট ও শর্করাও তার শরীরে গিয়েছিল। মেয়েটির বয়স কম হওয়ায় বাঁচার সম্ভাবনা আরও বেড়ে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেন চিকিৎসকেরা।
কৃষ্ণেন্দুবাবুর কথায়, মেয়েটি ১৭ দিনের মধ্যে শেষ দু’দিন জল বা খাবার পায়নি। মানুষ খাওয়া বন্ধ রাখলে প্রথম ২৪ ঘণ্টা যকৃৎ আপনাআপনি শর্করা তৈরি করে। তাতেই শরীর চলে। ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেলে যকৃৎ আর নিজে থেকে শর্করা বানাতে পারে না। তখন দেহের জমা ফ্যাট ভেঙে যকৃৎ-এ আসে। সেখান থেকে শর্করা তৈরি হয়। কিন্তু মানুষ যখন শারীরিক-মানসিক ভাবে খুব চাপের মধ্যে থাকে, তখন দেহের ফ্যাট না-ও ভাঙতে পারে। তার বদলে তখন মাংসপেশীর প্রোটিন ভেঙে যকৃৎ-এ গিয়ে শর্করা তৈরি করে। তাতেই মানুষের শরীর চলে। মেয়েটির ক্ষেত্রেও শেষ দু’দিন সেটাই হয়েছিল বলে মনে হয়।
|