ভয়ের দেশে আজ, শনিবার ঐতিহাসিক ভোট।
এত আতঙ্ক সঙ্গী করে আগে হয়তো কখনও ভোটে যায়নি পাকিস্তান। অথচ এই প্রথম বার এ দেশে পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা কোনও নির্বাচিত সরকারের হাত থেকে আরও একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা যেতে চলেছে। সমীক্ষা বলছে, ভোটদাতার ভিড় হতে পারে রেকর্ড-ভাঙা। ৮ কোটি ৬০ লক্ষ (নির্বাচন কমিশন সাড়ে তিন কোটিরও বেশি ভুয়ো ভোটারের নাম বাদ দেওয়ার পরেও) ভোটার বেছে নেবেন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ২৭২ জন সদস্যকে। পাশাপাশি ভোট হবে চারটি প্রাদেশিক আইনসভাতেও পঞ্জাব, সিন্ধু, বালুচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনওয়া। সব মিলিয়ে নির্বাচিত হবেন প্রায় এক হাজার জনপ্রতিনিধি।
ভোটের আগের রাত পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের যা পর্যবেক্ষণ, তাতে নওয়াজ শরিফের পিএমএল(এন)-এর একক বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসার প্রবল সম্ভাবনা। প্রায় নেতৃত্বহীন শাসক দল পিপিপি-কে দৌড়ে রাখছেন না কেউই। তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে নওয়াজের সামনে যেটুকু বাধা রয়েছে, তার কৃতিত্ব মূলত ইমরান খানের।
ভোটটা শেষ পর্যন্ত হচ্ছে। প্রচারপর্ব শুরু ইস্তক নেতা-ভোটদাতা, দু’পক্ষের কাছেই সেটা বড় স্বস্তি। কিন্তু থেকে থেকেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তালিবানের ভয়। ভোটের দিনেও হামলার হুমকি দিয়ে রেখেছে তারা।
গত এক মাস ধরে পাক নেতাদের একাংশ গা-ঢাকা দিয়ে প্রচার চালিয়েছেন। ল্যাম্পপোস্টে তাঁদের পোস্টার ঝুলেছে, টিভিতে বিজ্ঞাপন চলেছে, কিন্তু ওই নেতারা প্রকাশ্যে এসেছেন কদাচিৎ। এলেও বক্তৃতা করেছেন বুলেটপ্রুফ কাচের আড়ালে কিংবা ইন্টারনেটের ‘স্কাইপ’ বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। |
এই তালিকায় রয়েছেন পিপিপি-র চেয়ারম্যান বিলাবল ভুট্টো জারদারিও। তিনি নাকি প্রাণহানির ভয়েই গোটা প্রচারপর্বে প্রকাশ্যে আসেননি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির ছেলেকে ভোটের দু’দিন আগে অপহরণ করেছে জঙ্গিরা। এখনও তাঁর খোঁজ নেই।
বড় দলগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র নওয়াজের পিএমএল(এন) এবং ইমরানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-কেই প্রচার চালানোর ছাড়পত্র দিয়েছিল তালিবান। কারণ এই দুই দলই নাকি তাদের প্রতি কিছুটা নরম মনোভাবাপন্ন। এ ছাড়া তালিবান সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে চললে ফল ভুগতে হবে। গত এক মাসে চল্লিশের বেশি হামলা হয়েছে। নিহত শতাধিক, যাঁদের অধিকাংশই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ তিন দলের কর্মী-সমর্থক পিপিপি, এএনপি এবং এমকিউএম।
সন্ত্রাসের চোখরাঙানি সত্ত্বেও সিংহভাগ দেশবাসী চাইছিলেন, ভোটটা হোক। এমনকী সেনাপ্রধান আশফাক কিয়ানি বলে রেখেছিলেন, ভোট করাতে প্রয়োজনে শহরে-শহরে সেনা মোতায়েন করবেন তিনি। পাক সেনা সাধারণত নিজেদের স্বার্থেই ছোট ছোট দলের উত্থানে উৎসাহ দেয়। তার প্রমাণ মিলেছে তাহির উল কাদরির দল মিনহাজ-উল-কোরান-এর সমাবেশেও চোখে পড়ার মতো ভিড়ে। অনেকেই মনে করছেন, এ বার রিগিং বা অশান্তি তেমন হবে না। আসল চ্যালেঞ্জ হবে তালিবানি আতঙ্ককে হারানো।
ঠিক এইখানেই যুব সম্প্রদায়ের ওপর বড় ভরসা করছে সব পক্ষ। সাড়ে আট কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৪ কোটিরই এটা প্রথম ভোট। অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৫। তাদের কাছে টানতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি দলগুলো। জনসভায় মন ভাল করা গান, স্মার্ট স্লোগান, টিভিতে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বার্তা দেওয়া হচ্ছে নবীনদের। নতুন প্রজন্মকে নিয়েই পরিবর্তনের সুনামি তোলার ডাক দিয়েছেন ইমরান। আরব বসন্তের কথাও বলেছেন। আর মধ্যবিত্ত, শহুরে তরুণ ভোটারদের কাছে বিশ্বজয়ী ক্রিকেট অধিনায়কের গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। এর প্রধান কারণ তাঁর সৎ ভাবমূর্তি। |
গত ভোটে কার্যত অস্তিত্বহীন ইমরানের দল এ বার পঞ্জাবের শহর এলাকা এবং উত্তর-পশ্চিমের খাইবার-পাখতুনওয়ার কিছু এলাকায় শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে। মার্কিন ড্রোন হানার সমালোচনা করায় পশ্চিম-বিরোধিতার তকমাও গায়ে লেগেছে ইমরানের। তিনি আমল দেননি। প্রচারের শেষ বেলায় লাহৌরে ফর্কলিফ্টে চড়ে মঞ্চে উঠতে গিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। তার পর হাসপাতাল থেকে প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন। বলতে গেলে, তেহরিক-ই-ইনসাফ এই ভোটের ডার্ক হর্স। সেই ঘোড়া এখন পঞ্জাব প্রদেশে কেমন দৌড়য়, তার ওপরে নির্ভর করছে অনেক কিছু। ইমরান লাহৌরের ভূমিপুত্র হতে পারেন, কিন্তু পঞ্জাব আসলে শরিফ ভাইদেরই শক্ত ঘাঁটি। দাদা নওয়াজের চোখ যেমন পার্লামেন্টে, ভাই শাহবাজ তেমনই পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী পদে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যে নেমেছেন ভোট-ময়দানে।
পাক নির্বাচন সম্পর্কে একটা কথা খুব বলা হয় পঞ্জাব যার, পাকিস্তান তার। মোট ভোটার সংখ্যার পাঁচ কোটিই পঞ্জাবের বাসিন্দা। সমীক্ষা বলছে, এঁদের ৬০ শতাংশ শরিফেই মজে আছেন। এর একটা বড় কারণ অবশ্য পিএমএল(এন)-এর কর্মতৎপরতা। শরিফ ভাইয়েরা কাজ করে দেখিয়েছেন। ইসলামাবাদ পর্যন্ত মোটরওয়ে, লাহৌর থেকে নতুন বাস সংযোগ, ডেঙ্গি প্রায় নির্মূল করা এই সবের কৃতিত্ব তাঁদেরই। সব চেয়ে বড় কথা, বিনিয়োগকারীদেরও পছন্দের লোক শরিফরা। ভোটে জিতে আসার পর নতুন সরকারের সামনে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে পাকিস্তানের নড়বড়ে অবস্থাটা মেরামত। আর তা করতে হলে বিনিয়োগ টানা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এমনিতেই আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের কাছে দেনায় ডুবে রয়েছে পাকিস্তান। কাজেই শহরাঞ্চলের ভোট টানতে শরিফের উন্নয়নমুখী ভাবমূর্তি কাজে দিতে পারে। উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় অবশ্য অন্য অস্ত্র তাঁর। শরিফ বলেছেন, ক্ষমতায় এলে আমেরিকার মদতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ করবেন।
শরিফের বিরাট সুবিধে করে দিয়েছে দু’টো ঘটনা। প্রথমত, পিপিপি-র কোণঠাসা অবস্থা। পাঁচ বছরে তাদের কোনও উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই। বরং দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি এমনকী দিনে ষোলো ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং নিয়েও জনতা তিতিবিরক্ত। সব চেয়ে বড় কথা, দলটাই নেতৃত্বহীন। বেনজির ভুট্টো নেই, বিলাবল অন্তরালে। একাধিক দুর্নীতি মামলায় নাম জড়ানো আসিফ আলি জারদারি ভোটে নেতৃত্ব দিতে পারতেন, যদি না প্রেসিডেন্ট হতেন। এই অবস্থায় মনে করা হচ্ছে, গোটা ষাটেক আসন পিপিপি পেতে পারে, যার বেশির ভাগটাই হয়তো আসবে সিন্ধু প্রদেশ থেকে। সেখানকার গ্রামাঞ্চলে বেনজিরের নামে গরিবদের জন্য প্রকল্প চালু আছে। পিপিপি-র মুখরক্ষায় তাঁরাই বড় ভরসা।
শরিফের স্বস্তির দ্বিতীয় কারণ পারভেজ মুশারফ গৃহবন্দি। দীর্ঘ স্বেচ্ছা প্রশ্ন হল, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির চেহারাটা কেমন হবে? মোট আসন সংখ্যা ৩৪২। তার মধ্যে ভোট হবে ২৭২টি আসনে। সংরক্ষিত বাকি ৭০টি আসনে (৬০টি মহিলাদের জন্য এবং ১০টি অ-মুসলিমদের জন্য) প্রতিনিধিরা পরে মনোনীত হবেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য চাই ১৩৭টি আসন। পিএমএল(এন) একক বৃহত্তম দলের স্বীকৃতি পেলে নওয়াজ ছোট দলগুলিকে কতটা কাছে টানতে পারেন, তার ওপরেই নির্ভর করছে তাঁর মসনদ দখল। ইমরান জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি পিপিপি বা পিএমএল(এন)-এর সঙ্গে জোটে যাবেন না। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ইমরানের হাতে দর-কষাকষির মতো এমপি থাকবেন। তাঁর সঙ্গে জোট গড়ার সম্ভাবনা খারিজ করে দেয়নি পিপিপি। সন্দেহ নেই, ফল বেরোনোর পরেও বিস্তর নাটক মজুত থাকছে ঐতিহাসিক ভোটের রঙ্গমঞ্চে!
|