রাজ্য সরকারের শিল্পনীতি ঘোষণার জন্য ফের একটি দিন দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার রাজ্যের শিল্পবিষয়ক কোর কমিটির বৈঠকে তিনি জানিয়েছেন, রাজ্যের নতুন শিল্পনীতির খসড়া ১৫ দিনের মধ্যে ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে ‘স্বাগত’ জানালেও তৃণমূল সরকারের শিল্পনীতি নিয়ে তেমন কোনও আশার আলো দেখছে না শিল্পমহল। তাদের মতে, বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে সরকারের মনোভাবই প্রধান অন্তরায়। কিন্তু সরকার যে তার পুরনো অবস্থান থেকে নড়ছে না, এ দিন মুখ্যমন্ত্রী কার্যত ফের তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
বছর খানেক আগে মুখ্যমন্ত্রী এক বার ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্যের নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু তা হয়নি। এর পরে বলা হয়, গত জানুয়ারিতে হলদিয়ায় শতাধিক বিনিয়োগকারীর উপস্থিতিতে বেঙ্গল লিডস-এর মঞ্চ থেকে নতুন শিল্পনীতি ঘোষিত হবে। তা-ও হয়নি। তৃতীয় বারের জন্য জানানো হয়, গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের বার্তা দিতে মুম্বই শহরে যে ‘রোড শো’ হবে, সেখানেই নয়া শিল্পনীতি প্রকাশ করা হবে। শেষে ওই কর্মসূচিই বাতিল করে দেয় রাজ্য।
সরকার গঠনের প্রায় দু’বছরের মাথায় বুধবার, মহাকরণে শিল্পবিষয়ক কোর কমিটির বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চতুর্থ বারের মতো ঘোষণা করলেন, নয়া শিল্পনীতি ঘোষিত হতে চলেছে। সেটির খসড়া আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। দেওয়া হবে রাজ্যের নতুন বস্ত্রনীতির খসড়াও। যে কেউ এই নিয়ে মতামত দিতে পারবেন। তার ভিত্তিতে কোর কমিটির পরবর্তী বৈঠকে (৩ জুলাই) নতুন শিল্পনীতি চূড়ান্ত করা হবে। বার বার পিছিয়ে গেলেও মুখ্যমন্ত্রীর এই দিন ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাজ্যের শিল্পমহল। কিন্তু এইটুকুই। শিল্পনীতি নিয়ে তেমন আশার আলো দেখছেন না তাঁরা।
কেন? শিল্প-বণিকমহলের বক্তব্য, আগের সুরেই মমতা এ দিনও বুঝিয়ে দিয়েছেন, বেসরকারি অথবা যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পের জন্য এক ছটাক জমিও রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করবে না। জমির সমস্যা মেটাতে ঊর্ধ্বসীমা আইন তোলা হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে এই সরকার। আবার, আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায়, এমন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ঘোষণারও বিরোধী তৃণমূল। শিল্পমহল মনে করছে, বিনিয়োগের এই সব জ্বলন্ত সমস্যাকে পাশ কাটিয়েই তৈরি হবে নতুন শিল্পনীতি।
শিল্পে লগ্নি টানার দৌড়ে রাজ্য পিছিয়ে পড়লেও সরকার যে তাদের পুরনো সিদ্ধান্ত বদলাবে না, এ দিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী আরও এক বার তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বৈঠকে এসইজেড-এর প্রসঙ্গ তোলে বণিকমহল। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার এসইজেড নীতিতে কিছু রদবদল করেছে। তাতে জমির ন্যূনতম সীমা কমানো হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের ক্ষেত্রে জমির ন্যূনতম সীমা প্রায় থাকছেই না। ভারত চেম্বারের প্রেসিডেন্ট অশোক আইকতের আবেদন ছিল, কেন্দ্রীয় নীতির প্রেক্ষাপটে এ রাজ্যেও তথ্য প্রযুক্তি এসইজেড প্রকল্পগুলিকে বিবেচনা করুক রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী এ নিয়ে কোনও আশ্বাস দেননি।
পশ্চিমবঙ্গে বড় শিল্পের ক্ষেত্রে জমি অন্যতম বড় সমস্যা। তার সমাধান কী ভাবে হবে, তা নিয়েও চুপ মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে তিনি অবশ্য ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’-এর কথা বলেছেন। কিন্তু সেই ব্যাঙ্ক থেকে বড় মাপের জমি মিলবে না। বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন তুলছেন, এ সব বাদ দিয়ে শিল্পনীতি তৈরি করে কি বিনিয়োগ টানা যাবে?
মুখ্যমন্ত্রী জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন শিথিল করা (ভূমি সংস্কার আইনের ১৪ ওয়াই ধারার সংশোধন), যৌথ উদ্যোগে কিষাণ মাণ্ডি ও অত্যাধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ, নতুন পর্যটন কেন্দ্র (বকখালি-সাগরের মধ্যে যোগাযোগ, গজলডোবা, চা নির্ভর পর্যটন), কল্যাণী-বোলপুর-গোয়ালতোড়ে শিল্প তালুকের জন্য জমি চিহ্নিতকরণ, ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট হাইওয়ের অধীনে ৪ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি, দু’টি ফিল্ম সিটি তৈরির মতো নানা প্রকল্পের কথা জানান বৈঠকে, যা আগেও বহু বার তিনি বলেছেন।
এ দিনের বৈঠকে বণিকসভার প্রতিনিধিরা একাধিক প্রসঙ্গ তোলেন। যেমন, জমির মিউটেশন ও কনভার্সন হতে তিন বছরও লেগে যাচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য, কৃষি থেকে শিল্পের জমিতে রূপান্তরে এত সময় লাগলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের বলেন, এই সংক্রান্ত যে কোনও সমস্যায় মুখ্যসচিবের সঙ্গে কথা বলবেন। কলকাতা বিমানবন্দরের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষেবা নিয়ে আইটিসি কর্তা ওয়াই সি দেবেশ্বর এবং অম্বুজা গোষ্ঠীর মালিক হর্ষ নেওটিয়া মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেন। মমতা জানান, তিনি ইতিমধ্যে বিষয়টি কেন্দ্রকে জানিয়েছেন। বণিকসভাগুলিও যেন কেন্দ্রকে বলে। বৈঠকে প্রবেশ কর নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। মমতা সাফ জানিয়ে দেন, এই কর থাকবে, অন্য রাজ্যেও আছে।
গত দু’বছর ধরে কোর কমিটির ২০টি বৈঠক কার্যত নিষ্ফলা গিয়েছে। অবস্থা বদলাতে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এ বার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্ব এ দিনই প্রথম কোর কমিটির বৈঠক হল। সেই বৈঠকে শিল্প ও পরিকাঠামো বিষয়ক দশটি দফতরের মন্ত্রী ও সচিবরা ছিলেন। ছিলেন দশটি বণিকসভার সভাপতি এবং দেবেশ্বর-নেওটিয়ার মতো শিল্পকর্তারা। মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক বলেই হাজিরা ছিল একশো শতাংশ। বৈঠকে বক্তা ছিলেন শুধুই মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্প-প্রতিনিধিরা। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও কোনও কথা বলার সুযোগ পাননি।
আনুষ্ঠানিকতায় ত্রুটি না থাকলেও শিল্পকর্তারা এই বৈঠক থেকে নতুন কোনও দিশা পেলেন না। তবে তাঁরা এখনও ইতিবাচক কথাই বলছেন। দেবেশ্বর বলেন, “বৈঠকে দেওয়া তথ্য থেকে মনে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় ভালোই করেছে। আমি এই বৈঠকে খুব সন্তুষ্ট।” ধনসেরি গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান সি কে ধানুকা জানান, শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে জমি কোনও সমস্যা হবে না বলেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। বেঙ্গল চেম্বারের প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্ত ও মার্চেন্ট চেম্বারের প্রেসিডেন্ট দীপক জালানের আশা, বণিকমহলের সমস্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হলে প্রশাসনিক স্তরে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সিআইআই-এর পূর্বাঞ্চলীয় চেয়ারম্যান সুধীর দেওরা বলেন, “দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয় আনতে এ ধরনের বৈঠক জরুরি।” আইটিসি-কর্তা আশ্বাস দেন, রাজ্যে বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে তাঁর সংস্থা যে ৩০০০ কোটি লগ্নির কথা ঘোষণা করেছে, তার কাজ পুরোদমে চলছে। সারদা-কাণ্ডের জেরে ক্ষতিগ্রস্থ আমানতকারীদের আর্থিক সাহায্য দিতে সিগারেটের উপর ১০% বাড়তি কর বসানোর কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এতে কী রাজ্যের সিগারেট-ব্যবসায় সমস্যা হবে? জবাবে কিন্তু নিরুত্তর দেবেশ্বর। |