লগ্নি সংস্থার হাতে সাধারণ মানুষের প্রতারণা রুখতে এ বার নিজেই একটি ক্ষুদ্র সঞ্চয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। বুধবার এ খবর জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, মানুষের মতামত নিয়ে তবেই এই প্রকল্প সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরেই শুরু হয়েছে জল্পনা। অনেকেরই বক্তব্য, সারদা কেলেঙ্কারির জেরে ঘরে-বাইরে কোণঠাসা অবস্থা কাটাতে আগেই ৫০০ কোটির তহবিল গড়ার কথা বলেছিল রাজ্য সরকার। বুধবার দ্বিতীয় তাসটি বার করলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা এবং এই প্রকল্প চালানোর ব্যাপারে সরকারের যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। আর বিরোধী রাজনীতিকরা বলছেন, এটা জটিল পরিস্থিতিতে আমজনতার মন জয়ের চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রস্তাবিত ক্ষুদ্রসঞ্চয় ব্যবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “এটা অনেকটা ‘সোশ্যাল সিকিউরিটি স্কিম’ ধাঁচের। এতে সরকারের কাছে সাধারণ মানুষ টাকা গচ্ছিত রাখবেন। হয়তো বেশি সুদ দিতে পারব না। কিন্তু প্রতারণাও করা হবে না। টাকাটা মার যাবে না, সুরক্ষিত থাকবে।” মানুষ যেমন লক্ষ্মীর ভাঁড়ে টাকা জমান, এখানেও তেমনই সুযোগ থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন মমতা। |
রাজ্য সরকার কেন এই পদক্ষেপ করতে চায়, তা ব্যাখ্যা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “জনগণের সরকারের একটা দায়বদ্ধতা থাকে। মানুষ টাকা রাখার নিশ্চিন্ত জায়গা খুঁজছেন। ডাকঘরে, ব্যাঙ্কে আস্থা কমেছে। সুদ কমেছে। ওই সংস্থাগুলি (সারদার মতো লগ্নি সংস্থা) বেশি সুদের প্রলোভন দিচ্ছে। তাই মানুষ যেখানে-সেখানে টাকা রাখছেন।”
কিন্তু প্রকল্পটি সম্পর্কে সরকারের ভাবনা খোলসা করেননি মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে অর্থ দফতর একটা ওয়েবসাইট তৈরি করছে। এক মাস ওই ওয়েবসাইটটি খোলা থাকবে। তার মধ্যে যে কোনও মানুষ, এমনকী যাঁরা লগ্নি সংস্থায় প্রতারিত হয়েছেন বা যাঁরা এই ধরনের সংস্থায় কাজ করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন তাঁরাও মতামত জানাতে পারবেন। মানুষের মতামতের ভিত্তিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “এটা খুব স্পর্শকাতর বিষয়। এ নিয়ে আমি আর অর্থমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ কিছু বলবে না, কিছু করবে না।”
স্বাভাবিক ভাবেই অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। বলেন, “সরকারের ভাবনার চেহারাটা না জানতে পারলে আলোচনার সূত্রপাত হবে কী ভাবে?” অর্থমন্ত্রী অবশ্য কোনও আলোকপাত করেননি। তিনি বলেন, “সব প্রশ্নের জবাব আমাদের ওয়েবসাইটে থাকবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন, এটা একেবারে ভাবনাচিন্তার স্তরে রয়েছে। কোনও কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা কাজ শুরু করেছি। |
এর বাইরে কিছু বলার নেই।” মুখ খোলেননি রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘‘এর মধ্যে আমি ঢুকব না। আমি কি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে বৈঠক করি?” তবে অর্থ দফতর সূত্রের খবর, আগামী সপ্তাহে এই ওয়েবসাইট চালু হতে পারে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যবাসীর যে অংশের কথা ভেবে এই প্রকল্প চালু করার কথা বলেছেন, তাঁদের মধ্যে কত জনের পক্ষে ওয়েবসাইটে গিয়ে মতামত দেওয়া সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তা ছাড়া, রাজ্য সরকার নিজস্ব এক্তিয়ারে আদৌ এমন সঞ্চয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে কি না, বা সেই ব্যবস্থা কার্যকর করার মতো সামর্থ্য তাদের আছে কি না সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। অনেকে আবার এ-ও বলছেন, রাজ্য সরকারের ভাঁড়ে মা ভবানী। ঋণ করার উপরেও রাশ টেনে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই পরিস্থিতিতে ঘুরপথে ঋণ নেওয়ার পথ খুঁজছেন মমতা।
কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, তাকে লাভজনক ভাবে খাটিয়ে সুদ দেওয়া রাজ্য সরকারের পক্ষে কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সংশয়ী অনেকেই। ব্যাঙ্ক পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বলছেন, প্রথমত, গ্রামগঞ্জের গরিবগুর্বোদের কাছ থেকে নিয়মিত ভাবে টাকা তোলার পরিকাঠামোই রাজ্য সরকারের নেই। সেই পরিকাঠামো গড়ে তুলতে যে খরচ হবে, তাতে ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে। তার উপর তোলা টাকা বাজারে খাটানো পেশাদার ফান্ড ম্যানেজারদের কাজ। রাজ্য সরকারের হাতে তেমন পেশাদার কোথায়!
তা ছাড়া, রাজ্য সরকার যদি আশু অর্থসঙ্কটের কথা ভেবে এ ভাবে টাকা তোলার পরিকল্পনা করে থাকে, তা হলে আখেরে তাদের বিপদ বাড়তে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এই টাকা রাজ্য সরকারের দায় হিসেবেই দেখা হবে। ফলে ঋণের বাজারে রাজ্যের গ্রহণযোগ্যতা আরও কমবে। বাজার থেকে টাকা তুলতে আরও বেশি সুদ গুনতে হবে তাদের।
মহাকরণ সূত্রের মতে, রাজ্য সরকার তিন ভাবে ক্ষুদ্রসঞ্চয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। নতুন ব্যাঙ্ক খুলে, কেরল-মডেল অনুসরণ করে সরকারি চিটফান্ড গড়ে অথবা রাজ্যের সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে ঢেলে সেজে। নতুন ব্যাঙ্ক খুলতে হলে কেন্দ্রীয় সরকার, সেবি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি দরকার হবে। ইউকো ব্যাঙ্কের প্রাক্তন এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর বি কে দত্ত বলেন, “দেশে বর্তমানে দু’টি রাজ্যে রাজ্য সরকার পরিচালিত ব্যাঙ্ক রয়েছে। জম্মু কাশ্মীর ব্যাঙ্ক এবং কর্নাটক ব্যাঙ্ক। এদের সঙ্গে চলতি ব্যাঙ্কগুলির কোনও পার্থক্য নেই। তাতে আলাদা করে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা কী ভাবে করা সম্ভব, তা বোঝা যাচ্ছে না।” ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের প্রাক্তন সিএমডি ভাস্কর সেনের মতে, স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করার মাধ্যমেই সামাজিক সুরক্ষা সম্ভব। তার জন্য নতুন করে ব্যাঙ্ক খোলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না তিনি।
রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কের মাধ্যমেও ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন অনেকে। সমবায় ব্যাঙ্কের এক কর্তা বলেন, “রাজ্যে আমাদের ব্যাঙ্কের ৪৩টি শাখা রয়েছে। সরকার চাইলে এর সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব।” অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারও মনে করেন, সমবায় ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করা যায়। “তবে এগুলিকে আগে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করা দরকার।”
কেরল মডেল সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন, ১৯৬৯ সালে সাধারণ মানুষকে অর্থলগ্নি সংস্থার ফাঁদ থেকে বাঁচাতে নিজেরাই নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্স কোম্পানি তৈরি করেছিল কেরল সরকার। ওই সংস্থাটি ‘কেরালা স্টেট ফিনান্স এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেড’ বা ‘কেএসএফই’ নামে পরিচিত। পুরোপুরি সরকারি মালিকানায় নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত এই সংস্থাটি ‘সেন্ট্রাল চিটফান্ড অ্যাক্ট, ১৯৮২’-তে নথিভুক্ত। বর্তমানে বছরে কেএসএফই-র ব্যবসার পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি। ২০১২ সালে ৪২৭টি শাখা অফিসের মাধ্যমে ২৯ লক্ষ আমানতকারী এই সংস্থায় টাকা জমা রেখেছেন। মুখ্যমন্ত্রী এই মডেলই চালু করতে চান কি না, তা বলতে পারেননি অর্থ দফতরের কর্তারা।
বিরোধী নেতারা অবশ্য সরকারের এই প্রকল্পকে কার্যত সোনার পাথরবাটি বলে মনে করছেন। তাঁদের অভিযোগ, সারদা-কাণ্ড থেকে মানুষের নজর সরাতেই মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি এ ধরনের ভাবনার কথা ঘোষণা করেছেন। সিপিএমের এক নেতা বলেন, “আগে উনি কী করতে চান, তা ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। তার পরে বিষয়টির ভালমন্দ নিয়ে মন্তব্য করা যাবে।” |