সরকার গড়ার দু’বছরের মাথায় রাজ্যের শিল্প বিষয়ক কোর কমিটির খোলনলচে বদলে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাল, বুধবার মহাকরণে কোর কমিটির ২১তম বৈঠক পরিচালনা করবেন তিনি নিজেই। মহাকরণের খবর, শিল্প ও পরিকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত দশটি দফতরের মন্ত্রীদের পুনর্গঠিত কোর কমিটির সদস্য করা হয়েছে। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী নেতৃত্বে থাকায় কোর কমিটি আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারবে। বণিকসভার প্রতিনিধিরাও তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে পারবেন।”
২০১১ সালের মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই আলিপুরে শিল্পকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে কোর কমিটি গঠন করার কথা ঘোষণা করেছিলেন মমতা। ওই কমিটিতে শিল্পমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, তৎকালীন ক্ষুদ্র কুটির শিল্পমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া ছাড়াও রাজ্যের দশটি বণিকসভার সভাপতি বা চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলির সচিবদের রাখা হয়েছিল। সেই কোর কমিটির বৈঠক পরিচালনা করতেন শিল্পমন্ত্রী। |
মহাকরণ থেকে রাজভবনের পথে মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র |
কিন্তু এই কোর কমিটি কখনওই খুব একটা সক্রিয় হয়নি বলেই শিল্পমহলের অভিযোগ। মাসে দু’টি করে বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও কার্যত তা হতো না। এমনকী এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটা কমিটির বৈঠকে শিল্পমন্ত্রী ছাড়া অন্য কোনও মন্ত্রীর দেখাও পাওয়া যেত না।
অথচ, কোর কমিটি গড়ার বৈঠকে তার যে মূলমন্ত্রটি মুখ্যমন্ত্রী বেঁধে দিয়েছিলেন, তা হল ‘ডু ইট ইমিডিয়েটলি’। সেই সঙ্গে তিনি এ-ও বলেছিলেন, না পারলেও সেটাও দ্রুত বলে দিতে হবে। অর্থাৎ, কোনও প্রকল্প ঝুলিয়ে রাখা চলবে না।
কিন্তু কোর কমিটি যে ভাবে চলছিল, তাতে কমিটি গড়ার মূল উদ্দেশ্যটাই মার খাচ্ছিল বলে অভিমত শিল্প মহলের। বণিকসভার কর্তাদের বক্তব্য, শিল্পে বিনিয়োগের সঙ্গে অনেকগুলি বিষয় যুক্ত। যেমন, প্রবেশ কর, জমি, জল, বিদ্যুৎ, পরিবহণ ইত্যাদি। বৈঠকে এ সব নিয়ে প্রশ্ন উঠলে একা শিল্পমন্ত্রীর পক্ষে তার উত্তর দেওয়া সম্ভব হতো না। অন্য দফতরের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তও নিতে পারতেন না তিনি। নীতিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন হলে দফতরের সচিবরা কোনও উত্তর দিতে পারতেন না। ফলে কোনও প্রকল্প নিয়ে জট থাকলে তার চটজলদি সমাধানের কোনও পথই বেরোত না।
এই অবস্থায় কোর কমিটির দায়িত্ব এ বার নিজের হাতে তুলে নিলেন মুখ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে বাড়ানো হল তার কলেবর। এখন কমিটিতে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও থাকবেন শিল্পমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পঞ্চায়েতমন্ত্রী, ক্ষুদ্রশিল্প দফতরের প্রতিমন্ত্রী, নগরোন্নয়নমন্ত্রী, পরিবেশমন্ত্রী, বিদ্যুৎমন্ত্রী, পরিবহণমন্ত্রী এবং শ্রমমন্ত্রী। এ ছাড়াও থাকবেন সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির সচিব এবং ১০টি বণিকসভার সভাপতিরা। নতুন চেহারার এই কোর কমিটির বৈঠক হবে প্রতি দু’মাস অন্তর।
কোর কমিটির দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কি শিল্পমন্ত্রীর ডানা ছাটলেন? প্রশাসনের একাংশ এবং বণিকমহল অবশ্য বলছে, শিল্পমন্ত্রী নিজেই এমনটা চেয়েছিলেন। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী থাকলে কাজে গতি আসবে। অন্য মন্ত্রীরাও কোর কমিটিকে গুরুত্ব দেবেন। যা তাঁরা এত দিন দিচ্ছিলেন না। শিল্পমন্ত্রীর নিজের কথায়, “এতে অনেক সুবিধা হবে।”
এই পরিবর্তনে কিছুটা বিস্মিত হলেও বণিকমহল তাকে স্বাগতই জানিয়েছে। তাদের মতে, সরকারি দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে অসুবিধা হচ্ছিল। জমি ও অন্যান্য সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেখানেই থেকে গিয়েছে। কোর-কমিটির বৈঠকের আলোচ্যসূচি তৈরি করাই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এ বার তার পরিবর্তন হবে বলে আশা করা যায়।
যদিও শিল্পমহলের একটি অংশের মতে, জমি নীতি-সহ শিল্পায়নের মূল যে সব সমস্যা তা দূর না করে শুধু মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে কোর কমিটির বৈঠক করলে কাজের কাজ কিছু হবে না। জমি অধিগ্রহণের সরকারের ভূমিকা, শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন বাতিল, রাজনৈতিক দাদাগিরি ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের উচ্চ মহলে বহু বার দরবার হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। শিল্প কর্তাদের ওই অংশের মতে, বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর অংশগ্রহণ একটা ইতিবাচক দিক হলেও এই সব সমস্যার সমাধান না করলে শিল্পায়নের পরিবেশ তৈরি হবে না।
বুধবারের বৈঠকে আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আইটিসি-র চেয়ারম্যান ওয়াই সি দেবেশ্বর। সম্প্রতি সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের কথা ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী জানান, এর ১৫০ কোটি টাকা আসবে সিগারেটের উপর অতিরিক্ত ১০% কর বসিয়ে। প্রশাসন সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা নিয়েই কথা বলতেই বৈঠকে থাকবেন দেবেশ্বর। |