টাকা উদ্ধারের আশায় গোটা পূর্বাঞ্চলই কমিশনের দরবারে
ত্তরপ্রদেশের বালিয়ার উমেশ প্রসাদ। বিহারের পটনার রামেশ্বর যাদব। ওড়িশার বালেশ্বরের ত্রিলোচন বেহেরা। অসমের গোসাঁইগাঁওয়ের সুরেশ্বর প্রসাদ। পশ্চিমবঙ্গের আরামবাগের সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
পাঁচ রাজ্যের বাসিন্দা হলেও ওঁদের মধ্যে মিল বিপন্নতায়। মিল টাকা উদ্ধারের আশাতেও। ওঁদের সকলের কাছেই মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিয়েছে সারদা-তদন্তে গড়া শ্যামল সেন কমিশন। আর এ ভাবে গোটা পূর্ব ভারতকেই নিউ টাউনে টেনে এনেছে সারদা কেলেঙ্কারি! শুধু বিভিন্ন রাজ্যের সমাবেশই নয়। নিউ টাউনে কমিশনের দরবার ঘিরে রোল-চাউমিন-ফ্রায়েড রাইসের স্টলও হাজির। হাহুতাশ যতই থাক, পেটেও তো কিছু দিতে হবে!
আর পেটের ভাত-রুটি লোপাট হতে বসেছে বলেই নিউ টাউনের ফিনান্সিয়াল সেন্টারে সোমবার সকাল থেকে বিরস মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন উমেশরা। ওঁদের কেউ এজেন্ট। কেউ আমানতকারী।
ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সারদার এক আমানতকারী।
কেউ সারদা গোষ্ঠীতে টাকা রেখে সর্বস্ব খুইয়েছেন। কেউ আবার আমানতকারীদের ভয়ে বাড়িতেই ঢুকতে পারছেন না। বছর পঁয়ত্রিশের উমেশ সারদার এজেন্ট। সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন ধরা পড়ার পরে হিন্দি চ্যানেলের দৌলতে এলাকায় জানাজানি হয়ে গিয়েছে, সারদায় রাখা টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। শুধু বালিয়া নয়, লাগোয়া বিহারের বিভিন্ন গ্রাম থেকেও টাকা তুলেছেন উমেশ। কমিশনে এসে তিনি জানতে চাইছিলেন, কোথায় গেলে সমস্যার কথা বলতে পারবেন। জেলার এজেন্ট ও আমানতকারীদের অভিযোগ নেওয়ার জন্য কাউন্টার তৈরি হয়েছে। সেখানে লাইন দিচ্ছেন মানুষ। কিন্তু উমেশদের জন্য কোনও কাউন্টারের ব্যবস্থাই হয়নি।
উমেশ, রামেশ্বর, ত্রিলোচনেরা তাই এ-দিক ও-দিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। উমেশ বলেন, “বিহার ও উত্তরপ্রদেশ মিলিয়ে সারদার আমানতকারীর সংখ্যা হাজারেরও বেশি। এজেন্ট প্রায় ৩০০। বিহারে ৯০ লক্ষ টাকা, উত্তরপ্রদেশে প্রায় চার কোটি টাকা তছরুপ হয়েছে। টাকা ফেরতের জন্য কলকাতায় যাচ্ছি বলে এসেছি।” “কমিশন নাকি টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু কার কাছে গিয়ে যে সব কিছু বলব, বুঝতে পারছি না। একটা কিছু তো জেনে যেতে হবে। নইলে বাড়ি ফিরব কী করে,” বিড়বিড় করছিলেন উমেশ।
মানিব্যাগে রাখা ফোটোয় স্ত্রী আর ছেলের মুখটা এক বার দেখলেন বালিয়ার যুবকটি। ফের তা ঢুকিয়ে রাখলেন ব্যাগে। বারবেলায় উমেশের চোখে আশার আলো। বর্ধমানের কাউন্টারে এক সময় অভিযোগপত্র জমা নেওয়া হল তাঁর। কমিশনের স্ট্যাম্প মারা প্রাপ্তিস্বীকারের কাগজটা ভাঁজ করে মানিব্যাগে রাখলেন উমেশ। বাস ধরার জন্য বেলেঘাটায় ছুটতে ছুটতে বললেন, “এতেই হবে। অন্তত বাড়ি ঢুকতে পারব।”
কমিশনের কার্যালয় থেকে আবেদনপত্রের ফোটোকপি সংগ্রহ করছেন সারদার আমানতকারীরা।
উত্তরবঙ্গ ছাড়া গোটা পশ্চিমবঙ্গও হাজির নিউ টাউনে। গণেশ গুপ্ত নামে উল্টোডাঙার এক এজেন্ট ভাঙা হাত নিয়ে এসেছিলেন অভিযোগপত্র জমা দিতে। বলেন, “আমানতকারীরা বাড়িতে টাকা চাইতে এসে কটু কথা শোনাচ্ছেন। বাড়িতে টিকতে পারছি না।” গণেশের অভিযোগ, দিন কয়েক আগে পাড়ার কিছু আমানতকারীর সঙ্গে তাঁর ঝামেলা হয়। কয়েক জন আমানতকারী তাঁকে মোটরবাইক থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়ায় তাঁর হাত ভেঙে যায়। গণেশ জানালেন, তাঁর ২৫০ জন আমানতকারীর ৪০ লক্ষ টাকা হাওয়া হয়ে গিয়েছে।
ভাঙা পা নিয়ে এ দিন অভিযোগ জমা দিতে এসেছিলেন আরামবাগের সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি জানান, ২০০৩ সালে গাড়ির ধাক্কায় তাঁর পা জখম হয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিমা কোম্পানি থেকে তিনি চার লক্ষ চার হাজার ছ’শো পঁচিশ টাকা পান। পা জখম বলে কাজ চলে যায়। বিমা থেকে পাওয়া টাকার অধিকাংশই তিনি সারদায় বিনিয়োগ করেছিলেন। এসেছেন অভিযোগপত্র জমা দিতে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জ্যোৎস্না মণ্ডল পাঁচ বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। তিনি বলেন, “দুল আর বালা বন্ধক দিয়ে টাকা রেখেছিলাম সারদায়।” মেমারি থেকে আসা এজেন্ট পাপিয়া বাগচি বলেন, “আমানতকারীরা বিশ্বাস করতেন। বাড়িতে গেলে খাতিরযত্ন করতেন। এখন ওঁরাই আমাদের দেখলে খারাপ কথা বলছেন। মারতে উদ্যত হচ্ছেন। টাকা কবে ফেরত পাব, জানি না। ভাবছি, বাড়ির দু’টো ঘর ভাড়া দেব। সেলামি থেকে কিছু টাকা দেব আমানতকারীদের।”
কমিশন সূত্রের খবর, সোমবার নিউ টাউনে ৮৫৬৬টি অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। কী কী নথি লাগবে, না-জানায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন অনেক আমানতকারী ও এজেন্ট। নথি ফোটোকপি করতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। কাউন্টারের কাছেই ফোটোকপি করার কাউন্টার। সেখানে এক টাকার বিনিময়ে নথি ফোটোকপি করাচ্ছিলেন আমানতকারী ও এজেন্টরা।
আর মিনি পূর্বাঞ্চলের মানুষদের চাহিদা মেটাতে কমিশনের অফিসের সামনে বসে যায় খাবারের স্টলও। রোল-চাউমিন ছাড়াও পাওয়া যাচ্ছে চিলি চিকেন। নানান মিষ্টিও। কুন্তল দাস নামে বর্ধমানের এক এজেন্ট বললেন, “সেই ভোরবেলায় কিছু না-খেয়ে বেরিয়েছি। খাবরের স্টলটাই বাঁচিয়ে দিল।” স্টলের এক কর্মী বলেন, “প্রচুর চিলি চিকেন ও ভেজিটেবল ফ্রায়েড রাইস বিক্রি করেছি ৬০ টাকায়। স্টলে বিরিয়ানিও রাখা হবে।” কমিশনের অফিসের কাছে একমাত্র চায়ের দোকানেও লম্বা লাইন। অন্যান্য দিন ক্রেতার আশায় বসে থাকেন বিক্রেতা। এ দিন ক্রেতাদের ভিড়ে তিনি মহাখুশি।
আজ, মঙ্গলবার সারদা কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ১০০ জনের সাক্ষ্য নেবে কমিশন। বেলা সাড়ে ১২টায় সাক্ষ্য শুরু হবে। কমিশনের চেয়ারম্যান শ্যামলকুমার সেন এবং অন্য দুই সদস্য অম্লান বসু ও যোগেশ চট্টোপাধ্যায় থাকবেন। কমিশনের এক মুখপাত্র জানান, কমিশনে দু’দিন সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ওই দু’দফায় ৫২ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে কমিশন।

—নিজস্ব চিত্র

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.