হলফনামায় উল্টো দাবি
লগ্নি সংস্থাদের দৌরাত্ম্য জানা ছিল বহু আগেই
য়লা বৈশাখের আগে রাজ্যে লগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম নিয়ে তাঁর কিছু জানা ছিল না বলে দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ গত কয়েক দিন ধরেই অন্য কথা বলছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি, আয়কর দফতর বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তারা জানাচ্ছিল, এই সব লগ্নি সংস্থা সম্পর্কে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরকে দফায় দফায় অবহিত করা হয়েছে। এ বার রাজ্য সরকার নিজেই হাইকোর্টে দাখিল করা হলফনামায় জানিয়ে দিল, রাজ্যে লগ্নি সংস্থার রমরমার বিষয়টি ২০১১ সালের মে মাসেই (অর্থাৎ তৃণমূল ক্ষমতায় আসার ঠিক পরে) জানতে পেরেছিল তারা। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছিল।
সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছেন এক আইনজীবী। সেই মামলায় রাজ্য সরকারকে হলফনামা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। বৃহস্পতিবার হলফনামা জমা দেয় রাজ্য। তার ছয় নম্বর পাতায় লগ্নি সংস্থা নিয়ন্ত্রণে ২০০৯ সালে রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল (যা এই সে দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পড়ে ছিল) সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে: ‘২০১১ সালের মে মাসে ক্ষমতায় এসেই বর্তমান সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে রাজ্যের অর্থসচিবকে বিলটিতে দ্রুত ছাড়পত্র আদায় করার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নির্দেশ দেয়।... ২০১২-র অক্টোবরে রাজ্যে সক্রিয় চিট ফান্ডগুলির বেআইনি কাজকর্ম সম্পর্কে অর্থসচিবকে অবহিত করেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব। অর্থসচিবের নির্দেশে অর্থ দফতরের ইকনমিক অফেন্স ইনভেস্টিগেশন সেল কিছু তদন্তও করে...।’ সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, লগ্নি সংস্থাগুলির কাজকর্ম সম্পর্কে রাজ্য সরকার যে মোটেই অন্ধকারে ছিল না, এই হলফনামাই তার প্রমাণ।
রাজ্য সরকারের ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের কাছেও যে লগ্নি সংস্থাগুলির বেআইনি কাজ সম্পর্কে খবর ছিল, তা আগেই কবুল করেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। বস্তুত, এই ধরনের সংস্থার ফলাও কারবারের কথা জানিয়ে ২০১১-র অগস্টেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি। চিঠির সঙ্গে ১৫টি লগ্নি সংস্থার নামের তালিকাও পাঠানো হয়েছিল। সেই চিঠির জবাবে কী ভাবে ওই সব সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা জানিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কিন্তু রাজ্যের তরফে আর কিছুই করা হয়নি বলে অভিযোগ।

কমিশনের কার্যালয়ে লগ্নির কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন
সারদার এজেন্ট ও আমানতকারীরা। —নিজস্ব চিত্র
আবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও দাবি করছে যে, রাজ্যে সক্রিয় লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে তা জানিয়ে ২০১১ সালের ২৫ অগস্ট প্রথম চিঠি দেন মন্ত্রকের যুগ্মসচিব কে কে পাঠক। ওই বছরের ২০ অক্টোবর দ্বিতীয় চিঠি দেন মন্ত্রকের ডেপুটি সেক্রেটারি কে মুরলীধরণ। এর পরেও বিষয়টি মনে করিয়ে চিঠি পাঠানো হয় ২০১১-র ১৬ ডিসেম্বর এবং ২০১২-র ২৪ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু কোনও চিঠিরই উত্তর দেয়নি রাজ্য। এই সব তথ্য এবং রাজ্য সরকারের হলফনামা লগ্নি সংস্থার কাজকর্ম বন্ধে গাফিলতির অভিযোগকেই পুষ্ট করল বলে আইনজীবীদের একাংশের মত।
সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত চেয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা আইনজীবী বাসবী রায়চৌধুরীর অভিযোগ ছিল, রাজ্য সরকার দু’বছর ধরে গোটা বিষয়টি বসে বসে দেখেছে। ওই সব লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। সেই অভিযোগ নস্যাৎ করার জন্য হলফনামায় তৎপরতার যে বিবরণ রাজ্য সরকার দিয়েছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রীর কিছু না-জানার দাবি অনেকটাই লঘু হয়ে গেল বলে মনে করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারের এক প্রথম সারির নেতার মন্তব্য, “সারদা কাণ্ডের পরে রাজ্য সরকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু পদক্ষেপ করেছে। কিন্তু সরকারি তরফেই নানা অসংলগ্ন মন্তব্যের জন্য সাধারণ মানুষ আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। এই ত্রুটি অবিলম্বে মেরামত করা দরকার।”
হলফনামায় বলা হয়েছে, ২০১২-র অক্টোবরে ইকনমিক অফেন্স ইনভেস্টিগেশন সেলের তদন্তে লগ্নি সংস্থাগুলি কী ভাবে মানুষকে ঠকাচ্ছে তা ধরা পড়ে। বোঝা যায়, ২০০৯ সালে যে বিল পাশ করা হয়েছিল, তা আরও কড়া করা প্রয়োজন। এর পরই কেন্দ্রের কাছ থেকে বিলটি ফেরত চাওয়া হয়। এই বক্তব্য যে কার্যত মুখ্যমন্ত্রীর দাবিরই বিরোধিতা করছে, সে কথা পরবর্তী শুনানিতে উল্লেখ করবেন বলে জানিয়েছেন জনস্বার্থ মামলাটির সঙ্গে যুক্ত একাধিক আইনজীবী।

* হাইকোর্টে পেশ করা রাজ্যের হলফনামার প্রতিলিপি
রাজ্য সরকারের একটি সূত্রের বক্তব্য, অর্থ দফতরের অধীনে যে ইকনমিক অফেন্স ইনভেস্টিগেশন সেল রয়েছে, সেটি কার্যত অকেজো। সেখানে হাতে গোনা কয়েক জন কর্মী রয়েছেন। তাঁরা কী ভাবে, কী তদন্ত করে রিপোর্ট দিলেন এবং সেটা কী ভাবেই বা হলফনামায় চলে এল, গোটাটাই বিস্ময়ের।
বস্তুত, শুধু আইনের দরবারে নয়, রাজনীতির ময়দানেও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বক্তব্য। মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেছেন, “সেবি থেকে আরম্ভ করে কেন্দ্রের আর্থিক অপরাধ দমন শাখা ৬ মাস আগেই এই সব লগ্নি সংস্থা সম্পর্কে রাজ্যকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু রাজ্য কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। বরং দেখছি, দেখব বলে ওই সব সংস্থার টাকা বিদেশে পাচার করার সুযোগ করে দিয়েছে।”
এই নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ এবং সিবিআই তদন্তের দাবি নস্যাৎ করাটাই যে হেতু আপাতত রাজ্য সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য, সে হেতু গত দু’বছরে লগ্নি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থার তালিকা হলফনামায় জোর পেয়েছে বলে আইনজীবী মহলের একাংশের মত। আর সেটা করতে গিয়েই খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যও মাথায় রাখা হয়নি। সারদা কাণ্ডের তদন্তভার কেন সিবিআই-কে দেওয়া উচিত নয় তা বোঝাতে গিয়ে হলফনামায় আরও বলা হয়েছে, প্রতারণার অভিযোগ পাওয়ার পরেই তদন্ত শুরু হয়েছে। মূল অভিযুক্ত গ্রেফতারও হয়েছেন। প্রাক্তন বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিশন ও বিশেষ তদন্তকারী দল তদন্ত করছে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে এবং নতুন আইনের বলে রাজ্য সরকার এই ধরনের ব্যবসা বন্ধ করতে সক্ষম হবে। এই পর্যায়ে তদন্তে কোনও গাফিলতি নেই। এখন সিবিআই-এর হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়াটা অপরিণত সিদ্ধান্ত হবে।
শুক্রবার অবশ্য এই মামলায় রায় দেয়নি প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ। এ দিন শুনানির শুরুতেই আবেদনকারীর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় আদালতকে জানান, রাজ্য সরকার বৃহস্পতিবার যে হলফনামা হাইকোর্টে জমা দিয়েছে তার প্রতিলিপি তাঁদের দেওয়া হয়নি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “মনে হচ্ছে রাজ্য সরকার মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তি চাইছে না।” জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি দেন, হাইকোর্ট ২ মে হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিলেও অন্য পক্ষদের প্রতিলিপি জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়নি। সুব্রতবাবুর বক্তব্য, হলফনামা জমা দেওয়া হলে অন্যান্য পক্ষকে তার প্রতিলিপি দেওয়া একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এর জন্য হাইকোর্টকে নির্দেশ দিতে হয় না। এটা সরকার পক্ষের জানা উচিত।
দেখা যায়, এই মামলায় যুক্ত অন্য কোনও পক্ষকেই রাজ্য হলফনামার প্রতিলিপি দেয়নি। ডিভিশন বেঞ্চ সব পক্ষকে প্রতিলিপি দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এ দিন আর মামলায় শুনানি হয়নি। আগামী বুধবার, ৮ মে পরবর্তী শুনানি হবে। তার আগে সব পক্ষকে হলফনামার প্রতিলিপি দিতে হবে রাজ্য সরকারকে।
হাইকোর্ট এ দিন মামলার রায় দেবে ধরে নিয়ে সিবিআই-এর পুলিশ সুপার আদালতে হাজির ছিলেন। সিবিআই সূত্রে বলা হয়, হাইকোর্ট নির্দেশ দিলে তারা এই তদন্তের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। থানায় কোনও অভিযোগ দায়ের না করলেও, অসমে তারা প্রাথমিক তদন্তের কাজ শুরুও করে দিয়েছে।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.