২৪ ঘণ্টা আগেই শ্যামবাজারের সভায় হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। শুক্রবার ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে তৃণমূলের সাধারণ পরিষদের সভায় দলীয় শৃঙ্খলার প্রশ্নে আরও কড়া দাওয়াই দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে নানা স্তরের নেতাদের মমতা স্পষ্ট জানালেন, মানুষের কাছে দলের ভাবমূর্তি সব সময়ে স্বচ্ছ রাখতে হবে। দলীয় পতাকার অসম্মান কোনও অবস্থাতেই বরদাস্ত করা হবে না।
তৃণমূলের একাধিক নেতার বক্তব্য, পঞ্চায়েত ভোট তো বটেই, আগামী লোকসভা ভোটেও দলের ‘সুশৃঙ্খল ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি’ যাতে বজায় থাকে, সেটাই নিশ্চিত করতে চান মমতা। সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি, খড়্গপুর-সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলের শাখা সংগঠনের কাজকর্মে তৃণমূল নেত্রী অসন্তুষ্ট। এ দিনের সভায় দলের শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের পাশাপাশি ছাত্র নেতাদেরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মমতা। তাঁর কড়া বার্তা, কোথাও দলের ছাত্রদের কোনও গোলমাল করতে দেখা যায়, তবে তাদের আর সংগঠনে রাখা হবে না। বহিষ্কার করা হবে।
শৃঙ্খলার প্রশ্নে মমতার এই কঠোর মনোভাবের ব্যাপারে তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের একাংশের বক্তব্য, গার্ডেনরিচ থেকে সারদা নানা ঘটনায় দলের জনপ্রতিনিধি, নেতা-কর্মীদের নাম জড়ানোয় নেত্রী যথেষ্ট বিব্রত। সিপিএম-সহ বিরোধীরা সেগুলি নিয়ে প্রচারে নামায় সমস্যা বেড়েছে। তৃণমূলের এক সূত্রের বক্তব্য, এ দিন মমতা কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, সারদা কাণ্ডে সিপিএমের অভিযোগ নিয়ে মাতামাতি না করে পঞ্চায়েত ভোটকে পাখির চোখ করতে হবে। দলের এক নেতা পরে বলেন, “নেত্রী আমাদের সবাইকে পাল্টা প্রচারে নামতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, চিট ফান্ড নিয়ে বিরোধীরা একটা হাতিয়ার পেয়ে গিয়েছে। ওদের হাতিয়ারকে ভোঁতা করতে হবে। এমন বক্তৃতা ওদের বিরুদ্ধে দিতে হবে, যাতে সিপিএম ঘরে ঢুকে যায়।” |
তৃণমূলের সাধারণ পরিষদের সভায় মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: সুদীপ আচার্য |
যে পঞ্চায়েত ভোটকে সামনে রেখে দলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে চাইছেন মমতা, সেই ভোট কবে হবে, তা অবশ্য এখনও অনিশ্চিত। ভোট সময়মতো না-করার দায় শাসক দলের উপরই চাপিয়েছে বিরোধীরা। মমতা এ দিনের সভায় জানান, তাঁরা গত সেপ্টেম্বরে ভোট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা এখনও না-হওয়ার জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও বিরোধীদের দায়ী করেছেন তিনি।
দলীয় কর্মীদের প্রতি শৃঙ্খলার বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি তৃণমূল সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান উপলক্ষে দলকে প্রচারের রাস্তায় নামাতে চান মমতা। ১৩ মে, বাম সরকারের পতনের দিনটিকে ‘মা-মাটি-মানুষ দিবস’ হিসেবে পালন করার জন্য দলকে নির্দেশ দিয়েছেন নেত্রী। ওই দিন কলকাতায় একটি কেন্দ্রীয় মিছিল হবে। সেই মিছিল আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছেন মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, যুব নেতা শুভেন্দু অধিকারী ও ছাত্র নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা।
অন্য দিকে, শ্যামবাজারের সভার পাল্টা জবাব দিতে এ দিন আলিমুদ্দিনে সাংবাদিক বৈঠক করেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, “যখন মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা পালন করে অভিযুক্তকে দ্রুত শাস্তি দিয়ে মানুষের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, তখন তিনি রাস্তায় নেমে ওভার-বাউন্ডারি মেরে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন!” শ্যামবাজারে মমতা যেখানে সভা করেছিলেন, সেখানে ৭ মে পাল্টা সভা করবে সিপিএমের কলকাতা জেলা কমিটি। সারদা কাণ্ডের প্রতিবাদে শ্যামবাজারেই এ দিন সভা করে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ। সভায় ছিলেন শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল এবং তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক দীপক ঘোষ।
সেলিম এ দিন বলেন, “বাম প্রতিনিধি দল ২০১১ সালের অগস্টে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ওই ধরনের সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়। পরে একই দাবিতে বিধানসভাতেও বামেরা সরব হয়। তখন তৃণমূলের হাতে বাম বিধায়করা আক্রান্ত হন। আসলে তৃণমূলের পক্ষ থেকে বার বার ওই ধরনের সংস্থার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ নস্যাৎ করার চেষ্টা হয়েছে।” বৃহস্পতিবার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবি দেখিয়ে মমতা অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর পূর্বসূরিও ওই ধরনের সংস্থার সভায় গিয়েছেন। সেই অভিযোগ উড়িয়ে সেলিম বলেন, “উনি যে সভার উল্লেখ করছেন, তাতে বুদ্ধবাবু যাননি। যদিও ওই সংস্থার একটি পোলট্রি উদ্বোধনের জন্য বিভিন্ন সংবাদপত্রে যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, তাতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ছিল।”
সারদা কাণ্ডের প্রেক্ষিতে দলের যে সমস্ত সাংসদ, মন্ত্রী বা নেতার নাম জড়িয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে এ দিনের সভায় মমতা কী বলেন বা বিরোধীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে নেত্রী কী নির্দেশ দেন, তা নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল তৃণমূল নেতাদের মধ্যে। ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে প্রায় দু’ঘণ্টার ওই রুদ্ধদ্বার সভায় মমতা ছাড়াও পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মুকুল রায় এবং অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বক্তৃতা দেন। মমতা নিজেই বলেন এক ঘণ্টা দশ মিনিট। সভায় উপস্থিত নেতাদের একাংশের সূত্রে জানা গিয়েছে, সারদা কাণ্ডে দলের যে সমস্ত জনপ্রতিনিধির নাম জড়িয়েছে, তাদের ব্যাপারে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি মমতা। বিরোধীদের প্রচারের রাজনৈতিক মোকাবিলার পাশাপাশি পূর্বতন সরকারের দুর্নীতি নিয়ে তাঁর সরকার তদন্ত করবে বলেও মমতা জানিয়েছেন।
এ দিনের সভায় দুই তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ ও সোমেন মিত্রকে দেখা যায়নি। লগ্নি সংস্থার বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার পরামর্শ দেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রতবাবু। তাঁর কথায়, “এক দিকে মানুষকে সচেতন করা হবে। অন্য দিকে প্রশাসন ওই সমস্ত সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।” তাঁর দাবি, “এক বছরের মধ্যেই চিট ফান্ডকে আমরা ঢিট করে দেব।” |