পুলিশ হেফাজতে ধনেখালির তৃণমূল সমর্থক কাজি নাসিরুদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে সিআইডি স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক অসীমা পাত্র এবং ধনেখালি থানার ওসি ও তদন্তকারী অফিসারের ‘কল ডিটেলস্’ কেন জোগাড় করেনি, তা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করল কলকাতা হাইকোর্ট।
|
কাজি নাসিরুদ্দিন |
বুধবার সিআইডি হাইকোর্টে পেশ করা রিপোর্টে জানিয়েছে, নাসিরুদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে কি না, তা জানতে চেয়ে গত ১৮ জানুয়ারি একাধিক বার ধনেখালি থানার ওসি এবং তদন্তকারী অফিসারকে ফোন করেন অসীমাদেবী। কিন্তু তিন জনের কথোপকথনের ‘কল ডিটেলস্’ আদালতে পেশ করতে পারেনি সিআইডি। ওই রাতেই পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয় নাসিরুদ্দিনের।
ওই মামলায় সিআইডি তদন্ত চলছে হাইকোর্টের নির্দেশেই। ফেব্রুয়ারি থেকে দফায় দফায় হাইকোর্ট সিআইডি-র কাছ থেকে তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে রিপোর্ট তলব করেছে। কিন্তু তদন্তের গতিপ্রকৃতি সন্তুষ্ট করতে পারেনি ডিভিশন বেঞ্চকে।এ দিন শুনানির সময়ে ‘এটা কি কোনও তদন্ত হচ্ছে’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় ডিভিশন বেঞ্চকে। প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, আগামী সোমবার এই মামলায় চূড়ান্ত রায় দেওয়া হবে। সে দিনই সিদ্ধান্ত হবে এই মামলার দায়িত্ব আর সিআইডি-র হাতে থাকবে কি না।
নাসিরুদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনায় সিবিআই তদন্ত দাবি করে জনস্বার্থের মামলা করা হয়েছিল হাইকোর্টে।
গত ১৮ জানুয়ারি রাতে পরিচয়পত্র ছাড়া গাড়ি চালানোর অভিযোগে ধরা হয় নাসিরুদ্দিনকে। পুলিশের দাবি, রাত সওয়া ১১টা নাগাদ নাসিরুদ্দিন থানার শৌচাগারে যান। দীর্ঘ ক্ষণ সাড়াশব্দ না পেয়ে শৌচাগার ভেঙে অচৈতন্য অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে নাসিরুদ্দিনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা অবশ্য পুলিশের ওই দাবি মানতে চাননি। তাঁদের অভিযোগ ছিল, লক-আপে পিটিয়ে মারা হয় নাসিরুদ্দিনকে। একই অভিযোগ ছিল নাসিরুদ্দিনের পরিবারেরও।
আবেদনকারীর পক্ষে আদালতকে জানানো হয়, ষড়যন্ত্র করে পুলিশ হেফাজতে খুন করা হয় নাসিরুদ্ধিনকে। বিধায়ক অসীমা পাত্রের সঙ্গে এই ষড়যন্ত্রের যোগ রয়েছে বলেও আদালতে অভিযোগ করা হয়। হাইকোর্ট এই অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে বলে সিআইডি-কে। কিন্তু সেই কাজে সিআইডি যে ভাবে এগিয়েছে, তাতে অসন্তুষ্ট আদালত। |
|
নাসিরুদ্দিন মৃত্যু মামলা |
ছয় প্রশ্ন |
• কেন তৃণমূল বিধায়কের বার বার ফোন ওসি-কে?
• নাসিরুদ্দিন ধরা পড়ল কি না তা নিয়ে কেন ফোন?
• ওই কথোপকথনের কল-ডিটেলস্ কেন রাখা হয়নি?
• ধনেখালির ওসি-কে জেরা করা হল না কেন?
• তদন্তে সিআইডি কিছু লুকোতে চাইছে কি না?
• নাসিরুদ্দিনকে চড় মারা হলে দেহের নানা জায়গায় ক্ষতচিহ্ন হল কী করে? |
|
ঘটনার দিন (১৮ জানুয়ারি) কেন একাধিক বার ধনেখালির তৃণমূল বিধায়ককে ধনেখালি থানার ওসি এবং তদন্তকারী অফিসারকে ফোন করতে হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী। তিনি বলেন, “কোনও থানা এলাকায় এক দিনে অনেক অপরাধের ঘটনা ঘটে। তা হলে একটি বিষয় নিয়েই কেন বিধায়ক বার বার ফোন করেছিলেন? সিআইডি কি কিছু লুকোতে চাইছে? না হলে ওসি-কে জেরা করার বদলে শুধু বিবৃতি নেওয়া হল কেন?” প্রসঙ্গত, তাদের কাছে দেওয়া বিবৃতিতে ওসি নাসিরুদ্দিনকে চড় মারার কথা স্বীকার করেছিলেন বলে সিআইডি-র রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বিচারপতি জায়মাল্য বাগচীর প্রশ্ন, “যদি শুধু চড় মারা হয়ে থাকে, তা হলে নাসিরুদ্দিনের দেহের নানা জায়গায় ক্ষতচিহ্ন হল কী করে?”
আবেদনকারীর আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য ও রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় আদালতে বলেন, “জানুয়ারি মাসের ঘটনা। এখন মে মাস। এক জন অসহায় মহিলা স্বামীর মৃত্যুর সুবিচার চাইছেন। কিন্তু যে পদ্ধতিতে সিআইডি তদন্ত করছে, তাতে মনে হচ্ছে তারা সত্যপ্রকাশ করতে চাইছে না। এটাতে যে পুলিশ-রাজনৈতিক দলের মিলিত চক্রান্ত রয়েছে, তা সিআইডি সামনে আনতে চাইছে না। তদন্তভার সিবিআইকে দেওয়া হোক।”
সরকারের পক্ষে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় জানান, অসীমা পাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কিন্তু এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়নি ডিভিশন বেঞ্চ।
আবেদনকারীর আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য শুনানির সময়ে আদালতকে জানিয়েছিলেন, বিধায়ক অসীমা পাত্র এবং তৃণমূল নেতা নাসিরুদ্দিনের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব কোনও গোপন বিষয় নয়। তাই গোটা ঘটনা সাজানো এবং এবং ষড়যন্ত্রের ফসল কি না, তা দেখা উচিত। হাইকোর্ট সেটাই খতিয়ে দেখতে বলেছিল সিআইডি-কে। এ দিন সেই রিপোর্টই পেশ করে সিআইডি। রিপোর্ট থেকে জানা যায়, নাসিরুদ্দিন যে দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের শিকার তা গত বছরের অগস্টেই তাঁর স্ত্রী মনুজা বিবি রাজ্যপালকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। সেখানে মনুজা বিবি লেখেন, তাঁর স্বামীকে মিথ্যা মামলায় জড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। পুলিশকে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানানো হলেও লাভ হয়নি। |