আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। কিন্তু নির্বাচনের দিন ঘোষণার পর থেকে ফল ঘোষণা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের বলে শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টে সওয়াল করলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী সমরাদিত্য পাল। তিনি বলেন, সংবিধান কমিশনকে
সেই অধিকারই দিয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেই অধিকার পালনের জন্যই কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দারের এজলাসে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকটি রায়ের উল্লেখ করে সমরাদিত্যবাবু এ দিন বলেন, মনের মধ্যে কোনও প্রশ্ন চিহ্ন রেখে নির্বাচন পরিচালনা করা যায় না। সমস্যার সমাধান না করে আগে দিন ঘোষণা করে দেব, তার পর কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করব, তা হতে পারে না। সমরাদিত্যবাবু আরও বলেন, অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট করতে গেলে আগে থাকতে আটঘাট বেঁধেই নামতে হয়। সহমতের ভিত্তিতে রাজ্য সরকার নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে। কিন্তু কত বাহিনী, তা রাজ্যের না কেন্দ্রের এ সবই ঠিক করার দায়িত্ব কমিশনের। তারা অবাধ ও
মুক্ত নির্বাচন করার জন্য সাংবিধানিক ভাবে দায়বদ্ধ। সেই দায় তারা কী করে সম্পন্ন করবে, তা সরকার ঠিক করে দিতে পারে না।
আদালতে নির্বাচন কমিশনের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে সমরাদিত্যবাবু বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজ্যের হাতে কী বাহিনী রয়েছে, নির্বাচনের দিন ঘোষণার আগে তা জানার পুরো অধিকার রয়েছে কমিশনের। আবার কমিশনও যে তথ্য জানতে পারবে, তা রাজ্যকে জানাবে। তাঁর কথায়, “নিয়ম হল, দুই পক্ষ যে তথ্য পাবে, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। আলোচনায় সহমত হওয়ার পরেই নির্বাচনের দিন ঘোষণা হবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণার ক্ষেত্রে সেই নিয়ম একেবারেই মানা হয়নি। রাজ্য সরকার উল্টো পথে চলেছে। তারা আগে দিন ঘোষনা করেছে, তার পর প্রস্তুতির কথা ভাববে বলে জানিয়েছে। এটা করা যায় না।” একই সঙ্গে তাঁর যুক্তি, “শুধু নিরাপত্তা বাহিনী নয়। পরিকাঠামো, অর্থ, যানবাহন, নির্বাচন কর্মী এবং পর্যবেক্ষক নিয়ে প্রস্তুতি শেষ হলে তবেই কমিশন নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করতে পারে। রাজ্য সরকারের কাছে বার বার এই সব বিষয়ে জানতে চেয়েও কমিশন কখনওই ইতিবাচক সাড়া পায়নি।
রাজ্য সরকার কমিশনকে
উপেক্ষাই করেছে।”
অনেকগুলি বিষয়ের সমাধান এখনও হয়নি বলে অভিযোগ করে সমরাদিত্যবাবু এ দিন বলেন, কমিশন জানে না, রাজ্যের হাতে কত পুলিশ রয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ব্যাপারেও কমিশন অন্ধকারে। নির্বাচনে খরচের টাকার বিষয়ে কোনও কথা রাজ্যের দেওয়া হলফনামায় নেই। এই অবস্থায় নির্বাচনের দিন কী করে ঘোষণা করা যেতে পারে! এই মামলায় ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার হাইকোর্টে হলফনামা জমা দিয়েছে। এ দিন শুনানির সময় রাজ্য সরকারের পক্ষে আরও একটি হলফনামা জমা দেওয়ার আবেদন জানানো হয়। বিচারপতি সমাদ্দার সেই আবেদন নাকচ করে দেন।
কী ভাবে রাজ্য সরকার প্রতিটি পদক্ষেপে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অসহযোগিতা করেছে, তার ব্যাখ্যা দিয়ে সমরাদিত্যবাবু বলেন, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কমিশন পর্যবেক্ষকের নাম পাঠানোর জন্য রাজ্য সরকারকে চিঠি দেয়। তাতে বলা হয়, রাজ্য সরকার নাম পাঠালে কাদের পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হল এবং কোথায় করা হল, তার বিজ্ঞপ্তি জারি করবে কমিশন। এ ক্ষেত্রেও কমিশন সরকারের থেকে সদুত্তর পায়নি। কমিশনের অন্য আইনজীবী লক্ষ্মীচাঁদ বিয়ানি বলেন, “কমিশন হল পরামর্শদাতা আর সরকার পরামর্শগ্রহণকারী। নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব কমিশনের। সরকার সেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবে। রাজ্য সরকার এই সহজ সত্যটা মানতে চায়নি।”
এ দিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শুনানি চলার কথা থাকলেও হাইকোর্টের এক আইনজীবীর মৃত্যুর কারণে বিকেল সাড়ে ৩টের সময় শুনানি বন্ধ করে দিতে হয়। বিচারপতি দু’পক্ষের আইনজীবীকে জানান, শুনানি শুরু হওয়ার আগেও তিনি জানতে না যে, আদালত সাড়ে ৩টের সময় ছুটি হয়ে যাবে। শুনানি চলাকালীন তাঁর একজন কর্মী বার অ্যাসোসিয়েশনের একটি চিঠি তাঁকে দেয়। তখনই তিনি জানতে পারেন, কোর্ট তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাবে।
পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত এই মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে শোনার জন্য দু’পক্ষের আইনজীবীই এ দিন বিচারপতি সমাদ্দারকে ধন্যবাদ জানান। আইনজীবী সমরাদিত্য পাল বলেন, হাইকোর্টে দীর্ঘ কর্মজীবনে তাঁর এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়নি। একই মত পোষণ করেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়ও।
এ দিন বিকালে পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় হাইকোর্টে যান। তিনি বিমলবাবুর সঙ্গে আধ ঘণ্টা আলোচনা করেন। পরে এজি-র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কয়েকটি বিষয়ে পরামর্শের প্রয়োজন বলে মন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম। আগামী সপ্তাহে রাজ্য সরকারের তরফে বিমলবাবু সওয়াল শুরু করবেন। মামলার পরবর্তী শুনানি মঙ্গলবার।
|