রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দ্বৈরথে শেষ পর্যন্ত একতরফা ভাবেই পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করার পথে এগোচ্ছে রাজ্য। শনিবার দফায় দফায় বৈঠক করে এমনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মহাকরণ সূত্রে খবর। রাজনৈতিক ভাবেও সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
আজ রবিবার তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় দলীয় অবস্থান জানাবেন। সেখানে সংঘাতের বার্তাই স্পষ্ট করে দেওয়া হবে বলে রাজনৈতিক সূত্রের খবর। এই সংঘাতের ক্ষেত্রে বাম আমলে তৈরি আইনকেই যে হাতিয়ার করা হচ্ছে, সেটা এ দিনও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। মুকুলবাবু এ দিন বলেন, “সরকার আইনের পথে থাকবে। কারও সঙ্গে বিরোধের প্রশ্ন নেই। সোজা রাস্তায় হাঁটা হবে।” পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্যেও একতরফা ভাবে দিন ঘোষণার কথা উঠে এসেছে। তাঁর কথায়, “যেখানে আইন আছে, সেখানে মতবিরোধের কোনও জায়গা নেই। কেউ তার অন্যথা করতে পারবে না। মতের পার্থক্য থাকতে পারে। প্রস্তাব থাকতে পারে। কিন্তু যা সিদ্ধান্ত হবে তা আইনমাফিকই হবে।” সাংবাদিকরা এই প্রসঙ্গে পঞ্চায়েত আইনের ৪২ ও ৪৩ ধারার উল্লেখ করেন। ৪৩ নম্বর ধারায় পুনর্বিবেচনার কথা বলা আছে। সুব্রতবাবুর কাছে জানতে চাওয়া হয়, কমিশন পুনর্বিবেচনা করতে বললে কী হবে? সরাসরি এর উত্তর না-দিয়ে সুব্রতবাবু পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, “তার পর?”
পঞ্চায়েতমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পিছনেই ভোটের দিনক্ষণ নির্দিষ্ট হওয়ার চাবিকাঠি রয়েছে বলে মনে করছেন প্রশাসনিক কর্তারা। পঞ্চায়েত দফতরের খবর, আইনে রাজ্য সরকার ভোটের দিন ঠিক করার অধিকারী। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা না মানলে সরকার কী করতে পারে তা আইনে স্পষ্ট নয়। অন্য দিকে, ভোট পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব সাংবিধানিক ভাবে কমিশনের উপর দেওয়া আছে। ফলে আইনি লড়াই হলে সরকার সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে না বলেই মনে করছেন প্রশাসনিক কর্তাদের বড় অংশ।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে রাজ্যকে শেষ যে চিঠিটি দিয়েছেন, সেখানেও বলা হয়েছে, কমিশনের ভোট করানোর অধিকার সাংবিধানিক। সংবিধানের ২৪৩ (কে) ধারায় বলা হয়েছে, ভোটার তালিকা থেকে ভোট পরিচালনার যাবতীয় অধিকার ও দায়িত্ব কমিশনের। ফলে সেই দায়িত্ব স্মরণে রেখেই রাজ্য সরকার দিন ঘোষণার ক্ষেত্রে কমিশনের মতামতকে গুরুত্ব দিক।
আইনি দিকটি খতিয়ে দেখতেই এ দিনের বৈঠকে অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায়কে ডাকা হয়েছিল। তিনিও জানিয়ে দেন, পঞ্চায়েত আইন মোতাবেক সরকার দিনক্ষণ ঠিক করতে পারে। কমিশন তা পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দিলে সরকার তা মানতে বাধ্য, নাকি তা উপেক্ষা করতে পারে এ নিয়ে কোনও স্পষ্ট কথা আইনে বলা নেই।
কমিশন সরকারের বিজ্ঞপ্তি মেনে নির্বাচনের পরবর্তী ধাপগুলি ঘোষণা না করলে কী করা হবে, তা-ও আইনে বলা নেই। আইন দফতরের কর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, আইন যখন স্পষ্ট নয়, তখন সংবিধানে যা লেখা রয়েছে সেটাই শিরোধার্য। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যেমন চাইবে, আদালতের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে বলে মত দিয়েছেন বরিষ্ঠ কর্তারা।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের একটি মহল থেকে বলা হচ্ছে, যদি কমিশনের সঙ্গে সম্মুখ সমরে যেতেই হয়, তা হলে রাজ্য পুলিশ দিয়ে এক দিনে ভোট করানোর ব্যাপারেই গোঁ ধরে থাকা উচিত মহাকরণের। সেই মতো বিজ্ঞপ্তিও জারি করা উচিত। তাতে আইনি লড়াইয়ে সরকার জিতলে ষোলো আনা লাভ। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার এর মধ্যেই রাজ্যপালের কাছে গিয়ে বিরোধের বিষয়টি জানিয়ে এসেছেন। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীও রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। পঞ্চায়েত ভোটের জটিলতা নিয়েও দু’জনে আলোচনা করেছেন বলে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে।
কমিশন এবং সরকারের কাজিয়ায় ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে বিরোধী দলগুলিও। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র শনিবার পুরুলিয়ায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর উচিত কমিশনের সুপারিশ মেনে তিন দিনে এবং কেন্দ্রীয়
বাহিনী এনে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা। তৃণমূলের স্বার্থেও এটা দরকার। কারণ, তৃণমূলের হাইকম্যান্ড যাঁদের প্রার্থী মনোনীত করবেন, তাঁরা সকলেই মনোনয়ন জমা করতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। তৃণমূলের হাত থেকেই তৃণমূলকে বাঁচাতে ওঁদের এটা মেনে নেওয়া উচিত।” কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সিও বলেন, “আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। রাজ্য সরকার গোঁ ধরে আছে, রাজ্য পুলিশ দিয়েই পঞ্চায়েত ভোট করানোর। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন না করালে রক্তাক্ত হবে রাজ্য।”
মুকুল রায় অবশ্য পাল্টা বলেন, “দু’বছরে সিপিএমের ১২ শতাংশ ভোট কমেছে। আরও তিন বছর সরকার রয়েছে। যে হারে ভোট কমছে তাতে সূর্যকান্তবাবু ও তাঁর দলের কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকবে না। ফলে উনি কী বললেন, তাতে কিছু যায় আসে না।” |