বৈষম্যের তথ্য সুপ্রিম কোর্টে
নেতাদের সুরক্ষাতেই ব্যস্ত পুলিশ, আমজনতা অরক্ষিত
মলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর নিরাপত্তায় রয়েছে ২৫ জন পুলিশ। তাঁর বাবা, কাঁথির সাংসদ শিশির অধিকারীর পাঁচ জন। আর শুভেন্দুর ভাই, তথা কাঁথি (দক্ষিণ)-র তৃণমূল বিধায়ক দিব্যেন্দু অধিকারী দু’জন রক্ষী নিয়ে চলাফেরা করেন।
অর্থাৎ শুধু অধিকারী পরিবারের পিছনেই সরকারের লাগছে ৩২ রক্ষী!
প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়েরও রক্ষীর সংখ্যা কম নয় ১০ জন। সরকারি নথি এ-ও বলছে, জঙ্গলমহলে মাওবাদী দৌরাত্ম্য হ্রাসের দরুণ সেখানকার অধিকাংশ সিপিএম নেতার দেহরক্ষী ফেরানো হলেও শালবনির তৃণমূল বিধায়ক শ্রীকান্ত মাহাতোকে ঘিরে থাকে ৯ জন পুলিশ। জঙ্গলমহলের আরও তিন বিধায়ককে চার জন করে রক্ষী দিয়েছে সরকার। মাওবাদী হুমকির জেরে ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ দশ জন কার্বাইনধারী রক্ষী পান। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত কুমারের নিরাপত্তায় মোতায়েন ন’জন।
ওটা না-হয় জঙ্গলমহল। কিন্তু দক্ষিণ ২৪ পরগনার এসপি’র পাহারায় সাত রক্ষী কেন? কেনই বা পূর্ব মেদিনীপুর বা নদিয়ার এসপি পাঁচ জন করে দেহরক্ষী নিয়ে ঘুরবেন?
নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার পিছনে এই বিপুল ব্যয় দেখে জনতার মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। উঠছেও। জবাব খুঁজতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন উত্তরপ্রদেশের এক বাসিন্দা। দিল্লির ছাত্রীকে ধর্ষণ-খুনের পরে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ-মামলা করে তাঁর অভিযোগ, ভিআইপি-নিরাপত্তা নিয়েই পুলিশ ব্যস্ত থাকায় সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা পাচ্ছেন না। যার প্রেক্ষিতে ভিআইপিদের নিরাপত্তা দানের ঢালাও প্রবণতায় অসন্তোষ প্রকাশ করে তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট।
মহাকরণ সূত্রের খবর: মামলাটির সূত্র ধরে সব রাজ্যের কাছে শীর্ষ আদালত জানতে চেয়েছে, সাধারণের সুরক্ষায় তারা কত পুলিশ দিচ্ছে? ভিআইপি-নিরাপত্তায় রক্ষীর সংখ্যা কত? ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ক’জন সরকারি খরচে ব্যক্তিগত রক্ষী পাচ্ছেন, র্যজ্যগুলোর কাছে সে তথ্যও তলব করেছে সর্বোচ্চ আদালত। পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা কী রকম?
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে মহাকরণ যে তথ্য দিল্লিতে পাঠিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে: এ রাজ্যে ১৬৯৮ জন ভিআইপি-র নিরাপত্তায় ২৯৫২ জন রক্ষী বরাদ্দ করেছে সরকার। অর্থাৎ, ভিআইপিপিছু গড়ে দেড় জনের বেশি। আর আমজনতার ক্ষেত্রে? প্রতি ১৬৫৮ জন মানুষের পাহারায় মাত্র এক জন পুলিশ! যার মানে, সাধারণ নাগরিকপিছু পুলিশের অনুপাতটা গাণিতিক রাশিতে ধর্তব্যেই আসে না।
আমনাগরিকের সরকারি নিরাপত্তার শোচনীয় ছবি দেশ জুড়েই। তবে পশ্চিমবঙ্গ এ ক্ষেত্রে বিহার-গুজরাত-উত্তরপ্রদেশের চেয়েও পিছিয়ে বলে জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় ‘ব্যুরো অফ পুলিশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’-এর তথ্য। “সাধারণ মানুষ যে পুলিশি নিরাপত্তা বলতে কার্যত কিছুই পান না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।” আক্ষেপ রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার।
স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, ক’বছরে পুলিশে তেমন নিয়োগ হয়নি। উপরন্তু ফি মাসে গড়ে ১১০ জন অবসর নিচ্ছেন। রাজ্যে ১ লক্ষ ২৭ হাজার পুলিশ থাকার কথা, আছে ৯৪ হাজার। ফলে মানুষকে নিরাপত্তা দানে ঘাটতি থাকছে। স্বরাষ্ট্র সূত্রের খবর: দু’বছরে হাজার চারেক সিভিক পুলিশ ও ভিলেজ পুলিশ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ-কর্তারাই মেনে নিচ্ছেন, তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য।
অথচ ভিআইপি-নিরাপত্তায় ঢালাও আয়োজন! দিল্লিতে পাঠানো স্বরাষ্ট্র-তালিকায় আছে মন্ত্রী থেকে বিচারক, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, তৃণমূলের একাধিক সংগঠনের কর্তা, প্রশাসনের পদস্থ অফিসার, মায় বিডিও, প্রাক্তন জনা চল্লিশ পুলিশকর্তারও নাম। ৭৩ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলেও জনপ্রতিনিধি হওয়ায় তাঁরা সরকারি খরচে রক্ষী পাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে যেমন আছেন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বা রাজ্যের প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হুমায়ুন কবীর, তেমন জিটিএ-র চিফ এগ্জিকিউটিভ বিমল গুরুঙ্গ বা সিপিএমের মিনাখাঁ-হাড়োয়ার জোনাল সম্পাদক অসীম দাসও। শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়ের মতো ‘বহু রক্ষী পরিবৃত’ নেতা-মন্ত্রীর পিছনে সুরক্ষা-ব্যয়ও চোখে পড়ার মতো।
শুভেন্দুবাবু অবশ্য সর্বক্ষণ ২৫ পুলিশ নিয়ে চলাফেরার কথা মানতে চাননি। “আদতে দু’জন থাকে। শুধু জঙ্গলমহলে গেলে পুলিশের সংখ্যা বাড়ে।” বলছেন তিনি। তাঁর দাবি, “আমার নিরাপত্তা জেড ক্যাটেগরির। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকই ঠিক করে দিয়েছে, কত জন সিকিওরিটি থাকবে।” শালবনির বিধায়ক শ্রীকান্তবাবুও বলেন, “আমি মোটরসাইকেলে যাতায়াত করি! রক্ষী নেব কী করে?” মকুলবাবুর মন্তব্য, “মাওবাদীদের খতম-তালিকায় নাম থাকায় কেন্দ্র আমাকে রক্ষী নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আমি মনে করি, এক জন রক্ষীও না-থাকলে ভাল।”
রাজ্য প্রশাসনের একাংশ অবশ্য এমন মনে করে না। এই মহলের বক্তব্য: সকলের প্রাণ মূল্যবান। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে রাজনৈতিক ভাবে আইন-শৃঙ্খলায় বিঘ্নের আশঙ্কা থেকে যায়। তাই নিরাপত্তায় তাঁদের অগ্রাধিকার প্রাপ্য। যদিও সুরক্ষা সরবরাহ প্রক্রিয়াটির ফাঁক গলে কেউ কেউ যে নিছক ‘আধিপত্য জাহির করতে’ রক্ষী নিয়ে ঘুরছেন, প্রশাসনের একাংশ তা কবুল করেছে। এক পুলিশকর্তা বলেন, “কীসের ভিত্তিতে কাদের রক্ষী দেওয়া হবে, তা চূড়ান্ত করতে নিরাপত্তা-অধিকর্তার নেতৃত্বে কমিটি থাকলেও বহু ক্ষেত্রে এসপি’রা একক সিদ্ধান্তে জেলার নেতাদের রক্ষী বরাদ্দ করেন, যার হিসেব মহাকরণে পৌঁছয় না।” মহাকরণের খবর, সুপ্রিম কোর্টে তথ্য পাঠাতে গিয়েই ব্যাপারটা স্বরাষ্ট্র দফতরের নজরে এসেছে।
নেতা-বিচারক-মন্ত্রী-সান্ত্রীর দেহরক্ষী কমালেই কি আমজনতার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে? হবে না বলেই মনে করেন রাজ্য পুলিশের একাধিক কর্তা। তাঁদের যুক্তি: দিল্লির ধর্ষণ-কাণ্ডের আগেই প্রতি থানায় অন্তত দু’জন মহিলা পুলিশ রাখার নির্দেশ পাঠিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। রাজ্যে মহিলা পুলিশ কম থাকায় তা মানা যায়নি। একই কারণে রাজ্যে দশটির বেশি মহিলা থানাও খোলা যায়নি। “ব্যারাকপুরে দেড় হাজার মহিলা কনস্টেবলের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে এক মাস হল। এখনও তঁদের থানায় পাঠানো হয়নি।” বলছেন এক স্বরাষ্ট্র-কর্তা। সমস্যার মূলে পৌঁছনো যাবে কী ভাবে, সে প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশাসনে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.