বিতর্কের বিষয়: পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের অবস্থা। দুই পক্ষ: কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার, বিশেষ করে বলতে গেলে, দুই সরকারের দুই শীর্ষ আমলা। কিন্তু প্রশাসনের এই দুই কর্তার
দাবি-পাল্টা দাবি, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, এর মধ্যে অনেকটা রাজনৈতিক তরজার ছায়া দেখছেন প্রশাসনেরই একাংশ। স্বভাবতই তা ঘিরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে মহাকরণের অন্দরে।
|
কেন্দ্রীয় কৃষিসচিব
আশিস বহুগুণা |
|
রাজ্যের মুখ্যসচিব
সঞ্জয় মিত্র |
কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের মতে, দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের ফসল পশ্চিমবঙ্গ ঘরে তুলতে পারেনি। শুধু তা-ই নয়, কেন্দ্রীয় কৃষিসচিব আশিস বহুগুণার অভিযোগ: বর্তমান সরকারের আমলে রাজ্যের চাষিরা পথে বসেছেন, তাঁরা বিপন্ন। এই অভিমত তিনি চিঠি লিখে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে। এতে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে রাজ্য। চিঠির জবাবে মুখ্যসচিব দাবি করেছেন, বর্তমান জমানায় রাজ্যের চাষিরা অভূতপূর্ব সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। তাই ‘চাষিরা পথে বসেছেন’ কিংবা ‘তাঁরা বিপন্ন’ জাতীয় মন্তব্য করার আগে কেন্দ্রীয় সচিবের আরও খোঁজ-খবর নিয়ে পরিসংখ্যান যাচাই করা উচিত ছিল বলে মুখ্যসচিব মন্তব্য করেছেন।
এমনকী, ভবিষ্যতে যাতে এমন ‘ভুল’ তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো না-হয়, সে ব্যাপারে দিল্লিকে ঠারেঠোরে সতর্কও করে দিয়েছেন সঞ্জয়বাবু।দুই সচিবের ‘পত্র-যুদ্ধ’ স্বভাবতই প্রশাসনিক মহলে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। অনেকেরই প্রশ্ন: এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ারের অধীনস্থ কৃষি মন্ত্রক হঠাৎ তৃণমূলশাসিত পশ্চিমবঙ্গের চাষিদের ‘অসহায় অবস্থা’ নিয়ে সরব হল কেন? কেনই বা কৃষি-সচিবের মতো পদস্থ কেন্দ্রীয় আমলা এ হেন ‘রাজনৈতিক ভাষায়’ চিঠি লিখতে গেলেন? পাশাপাশি কেন্দ্রের চিঠি পাওয়ার চার দিনের মাথায় রাজ্যের মুখ্যসচিবই বা কেন এ রকম ‘কড়া’ জবাব দিয়ে আরও বিতর্কের সম্ভাবনা বাড়ালেন, একান্তে সে প্রশ্নও তুলছেন মহাকরণের একাধিক কর্তা।
কেন্দ্রীয় কৃষিসচিব ঠিক কী লিখেছিলেন?
গত ১১ মার্চের চিঠিটিতে আশিস বহুগুণা মুখ্যসচিবকে লিখেছেন, ‘পূর্ব ভারতে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করতে ২০১২-র ২৬ সেপ্টেন্বর কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ার কলকাতায় বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে বলা হয়েছিল, ধান সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ানো জরুরি। সরাসরি চাষিদের থেকে নায্য মূল্যে ধান কিনতে রাজ্যের উদ্যোগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
কৃষিসচিব লিখেছেন, ‘যত দূর খবর, তাতে চলতি বছরের ৯ মার্চ পর্যন্ত রাজ্য সাকুল্যে ৯ লক্ষ ৮১ হাজার টন ধান সংগ্রহ করতে পেরেছে, যা গত বছরের তুলনায় অনেকটাই কম।’ বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে ধান উৎপাদনের পরিমাণের তুলনায় সংগ্রহের বহর নিতান্তই নগণ্য বলে চিঠিতে আক্ষেপ করেছেন কেন্দ্রীয় সচিব।
আর এরই প্রেক্ষিতে চিঠিতে তাঁর মন্তব্য, ‘পশ্চিমবঙ্গে বাড়তি ধান উৎপন্ন হয়েছে সবুজ বিপ্লবের কল্যাণে। রাজ্য তা কিনতে পারেনি, যথাযথ বিপণনের ব্যবস্থাও করে দিতে পারেনি। ফলে চাষিরা পথে বসেছেন। সময়ে ধান বিক্রি করে হাতে টাকা না-পাওয়ায় তাঁরা এখন বিপন্ন।’ তাই চাষিদের ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে ধান কেনায় জোর দিতে রাজ্যকে পরামর্শ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষিসচিব।
চিঠি পেয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিব বেজায় ক্ষুব্ধ। জবাবে গত ১৫ মার্চ তিনি কেন্দ্রীয় সচিবকে লেখেন, ‘আপনার চিঠিতে আমরা অবাক হয়েছি। জানিয়ে রাখি, ৯ মার্চ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ১৭ লক্ষ ৩৯ হাজার টন ধান সংগ্রহ হয়েছে, যার ৯ লক্ষ ২ হাজার টন কেনা হয়েছে চালকলের মাধ্যমে। বাকি ৮ লক্ষ ৩৭ হাজার টন সমবায় মারফত সরাসরি চাষিদের থেকে কেনা। সংগৃহীত ধান থেকে ১১ লক্ষ ৮২ হাজার টন চাল তৈরি হয়েছে, যার ৮ লক্ষ ১০ হাজার টন গিয়েছে ফুড কর্পোরেশনের গুদামে।’
এই হিসেব দিয়ে চিঠিতে মুখ্যসচিবের দাবি, ‘আপনি যে পরিমাণ ধান সংগ্রহের কথা বলেছেন, আমরা কার্যত তার দ্বিগুণ সংগ্রহ করেছি। গত কয়েক বছরে এত ভাল সংগ্রহ হয়নি।’ মুখ্যসচিবের এ-ও দাবি: চাষিরা নায্য মূল্য পেয়েছেন, এবং দ্রুত পেয়েছেন। জিরো ব্যালান্স অ্যাকাউন্ট খুলে চাষিদের চেকের মাধ্যমে টাকা মেটানোর ব্যবস্থা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। জবাবি পত্রের পরিশেষে কেন্দ্রীয় সচিবের প্রতি সঞ্জয় মিত্রের বার্তা, “আমার মনে হয়, এ রাজ্যের চাষিদের পথে বসার কথা বলে আপনি সত্যের অপলাপ করেছেন। আশা করি, পরবর্তী কালে এমন কিছু লেখার আগে সব দিক খতিয়ে দেখবেন।”
কিন্তু চাপান-উতোরের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে, এমন চিঠি কেন্দ্রীয় সচিব আচমকা লিখতে গেলেন কেন?
মন্ত্রকের খবর: সবুজ বিপ্লব খাতে কেন্দ্র থেকে রাজ্য বছরে গড়ে দু’শো কোটি টাকা পাচ্ছে। প্রকল্পের কাজ কেমন হচ্ছে, তা দেখতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ রাজ্যে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন।
প্রতিনিধিরা ফিরে রিপোর্ট দিয়েছেন যে, সবুজ বিপ্লবের সাফল্য পশ্চিমবঙ্গ কাজে লাগাতে পারেনি, কারণ চাষিরা ফসলের নায্য দাম পাচ্ছেন না বলে নানা জায়গা থেকে অভিযোগ মিলেছে। পাশাপাশি ধান সংগ্রহে সমস্যার কথাও প্রতিনিধিদের তরফে কৃষি মন্ত্রককে জানানো হয়। তারই সূত্র ধরে রাজ্যকে চিঠি দেন কেন্দ্রীয় কৃষিসচিব আশিস বহুগুণা।
উল্লেখ্য, আশিসবাবু আদতে পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের আইএএস অফিসার। একদা তিনি বনগাঁর মহকুমাশাসক পদে কাজ করে গিয়েছেন। পরে ক্যাডার পাল্টে চলে যান রাজস্থানে। যদিও পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে তিনি সম্যক খোঁজ-খবর রাখেন বলে আমলা মহলের খবর।
|