কেউ চিউইং গাম চিবোচ্ছেন। কেউ লজেন্স চুষছেন। কেউ বা চিনির কিউব নিয়ে বসে, যেন চা-কফির অপেক্ষায়।
সাদা চোখে দেখলে বোঝার উপায়ই নেই, এ সবই আসলে হরেক কিসিমের মাদক। কোনওটা ‘এমডিএমএ’, কিংবা ওই মাদকেরই ‘এক্সট্যাসি ট্যাবলেট’। কোনও ক্ষেত্রে চিনির কিউবের সঙ্গে মিশেছে কয়েক ফোঁটা ‘এলএসডি’। চলতি কথায় যার নাম অ্যাসিড।
কলকাতা ও আশপাশের কিছু বিলাসবহুল বাড়ি, ফ্ল্যাট ও ফার্ম হাউসে উচ্চবিত্তদের একাংশের পার্টিতে মাদকের চেহারা ও নেশার জিনিস নেওয়ার ধরন এখন এ রকমই বলে লালবাজারের গোয়েন্দারা জেনেছেন। তাঁদের দাবি, পরপর কয়েকটি ধরপাকড় ও উদ্ধারের পরে শহরে কোকেনের আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন অন্য ধরনের স্নায়ু-উদ্দীপক মাদক ছদ্ম চেহারায় ঢুকে পড়েছে। আর মাদকাসক্তেরা সেগুলো নিচ্ছেন এমন ভাবে, যাতে চট করে তাঁদের ধরা না-যায়। |
কলকাতা ও শহরতলিতে উচ্চকোটির বিভিন্ন পার্টির সংগঠক এবং পার্টিতে এই ধরনের মাদক-সরবরাহকারীদের অন্তত পাঁচ জনকে গ্রেফতার করতে তক্কে তক্কে রয়েছে লালবাজার। পুলিশের বক্তব্য, ওই পাঁচ জন নিজেরাই মাদকাসক্ত, ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে। বয়স ২৫ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। প্রত্যেকেরই বিলাসবহুল সেডান রয়েছে। আলিপুর, নিউ আলিপুর, নিউ টাউন কিংবা রায়চকের কোনও ফ্ল্যাট, বাড়ি কিংবা বাংলোয় তারা গোপনে পার্টির আয়োজন করে। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, ওই পাঁচ জনকে ধরা গেলে নতুন মাদকের সুলুকসন্ধান করা যাবে।
গত বছরের জুলাই এবং এ বছরের জানুয়ারিতে দু’দফায় মোট ৮০০ গ্রাম কোকেন কলকাতা থেকে উদ্ধার করেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। যার বাজারমূল্য প্রায় আট কোটি টাকা। জুলাইয়ের কোকেন-কাণ্ডে শহরের দুই ব্যবসায়ী ও দুই নাইজিরীয়-সহ মোট ন’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জানুয়ারি মাসে মাদক-পার্টির আয়োজক ও মাদক সরবরাহকারী অভিযোগে মোট ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়।
গোয়েন্দাদের দাবি, “মাদকের কারবারিরা ধরা পড়ায় শহরে কোকেন আমদানিতে ভাটা পড়ে যায়। এখন পার্টিগুলিতে তারই ‘বিকল্প’ আমদানি হয়েছে। এক অফিসারের কথায়, “আমাদের চোখকে ফাঁকি দিতে নতুন মাদক আনা ও সেবন দুয়েরই কৌশল বদলেছে। গোয়েন্দারা জেনেছেন, ‘মিথিলিন ডাইঅক্সি মেথঅ্যাম্ফিটামাইন’ (এমডিএমএ) বা ‘মেথ’ অনেক ক্ষেত্রেই আসছে ‘এক্সট্যাসি’ ট্যাবলেটের চেহারায়। পেট খারাপ সারাতে কার্যকর এক বিশেষ ধরনের ট্যাবলেটের সঙ্গে চেহারাগত দিক দিয়ে এক্সট্যাসি ট্যাবলেটের তেমন কোনও তফাত নেই। ওই ট্যাবলেট চোষার (মাদকাসক্তের ভাষায় ‘পপ’ করা) মিনিট পনেরো-কুড়ির মধ্যে হাল্কা ঘাম হবে শরীরে, এক অফুরন্ত এনার্জিতে চাঙ্গা লাগবে শরীর-মন দুটোই। চোখে ঘুম আসবে না। রাতভর পার্টি করার জন্য নেশাড়ুকে তৈরি করে দেবে ওই বড়ি। আবার ‘লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়াথিলামাইড’ (এলএসডি)-এর মতো পুরনো মাদক চিনির কিউবে আনার কৌশল একই সঙ্গে পুরনো ও পরিচিত বলে ব্লটিং পেপারের উপরে দু’-চার ফোঁটা এলএসডি ফেলে সেই বস্তু নিয়ে আসা হচ্ছে। নেশাড়ুরা চিউইং গামের সঙ্গে চিবোচ্ছেন ওই এলএসডি মাখা ব্লটিং পেপার।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, এই ধরনের পার্টিতে শুধু প্রবেশমূল্যই হাজার টাকা। মদ ও চাটের জন্য আরও হাজার চারেক টাকা। সেই সঙ্গে মাদক নেওয়ার খরচ তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তবে অদ্ভুত এক বৈপরীত্যও রয়েছে। মাদক যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁরা নিয়মিত জিমে যান, তেল-মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলেন। তা হলে নেশার বস্তুর প্রতি এত আকর্ষণ কেন? এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, “বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে আকর্ষণীয় থাকতে গেলে তো সুঠাম শরীর প্রয়োজন। আবার নেশাও করতে হবে। কিন্তু এতে তাঁদের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।”
পুলিশ কী করছে? লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “নতুন নতুন চেহারায় নেশার সামগ্রী গোয়া থেকে আসছে। কিন্তু কী ভাবে, কারা আনছে— সে ব্যাপারে আমরা অন্ধকারে।” ওই অফিসারের কথায়, “মাদক-পার্টির সম্ভাব্য জায়গাগুলির উপরে নজরদারি চলছে। খোঁজ চলছে ওই পাঁচ যুবকেরও। যারা একই সঙ্গে মাদকাসক্ত এবং মাদক-পার্টির আয়োজক। তবে শুধু গ্রেফতার নয়, তাদের বমাল গ্রেফতার করাটাই আসল। আমরা সেই চেষ্টাই করছি।”
|