|
|
|
|
তালা ভেঙে প্রেসিডেন্সিতে ঢুকে তাণ্ডব |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
প্রেসিডেন্সিকে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ পুলিশের চোখের সামনে সেই প্রতিষ্ঠানেরই ফটকের তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে, শিক্ষক-ছাত্রদের মারধর করে, গবেষণাগারে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ উঠল তাঁরই দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার দিল্লিতে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র যখন এসএফআইয়ের হাতে নিগৃহীত হন, তখন দিল্লি পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মমতা। বুধবারের ঘটনায় কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মালবিকা সরকার সবার আগে আচার্য-রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন এবং শিক্ষামন্ত্রীকে হামলার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন। তার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সিলেকশন কমিটির বৈঠক চলছিল। হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে দেখি তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পতাকা হাতে এক দল লোক তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে আসছে, ছাত্রদের মারছে। এরা কেউ প্রেসিডেন্সির ছাত্র নয়, বহিরাগত।” |
ভাঙা হয়েছে বেকার ল্যাবরেটরির জানলার কাচ। |
হামলাকারীদের আনা বল্লমও পড়ে রয়েছে। |
|
প্রেসিডেন্সির রেজিস্ট্রার এবং অন্য কর্তাদেরও অভিযোগ, ক্যাম্পাসে যারা চড়াও হয়েছিল, তাদের হাতে ছিল তৃণমূলের পতাকা। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “রাজনৈতিক রং না দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশকে।” ঘটনার প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধমর্ঘটের ডাক দিয়েছেন প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীরা। তবে টিএমসিপি-র দাবি, তাদের কেউ এই হামলায় জড়িত নয়। বরং প্রেসিডেন্সির ভিতর থেকেই তাদের মিছিলে ঢিল ছোড়া হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা অবশ্য সমস্বরে তা অস্বীকার করেছেন। লালবাজার সূত্রের খবর, বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে টিএমসিপি-র সদস্যেরা দলীয় পতাকা লাগাচ্ছিলেন। তখন গেটের উপরে থাকা একটি ইট ওই সদস্যদের এক জনের মাথায় পড়ে। তাতেই রটে যায়, ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে টিএমসিপি-র উপরে হামলা চালানো হচ্ছে।
ঘটনার সূত্রপাত বুধবার বেলা ১টা নাগাদ। মঙ্গলবার দিল্লিতে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে হেনস্থার প্রতিবাদে কলেজ স্ট্রিট দিয়ে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিল টিএমসিপি। পুলিশের নির্দেশেই তখন প্রেসিডেন্সির গেটে তালা লাগানো ছিল। অভিযোগ, আচমকাই মূল ফটকের তালা ভেঙে মিছিলের একটি অংশ ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। মালবিকাদেবীর অভিযোগ, “পুলিশ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল।” প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্রছাত্রীদেরও বক্তব্য, “পুলিশের সামনেই গোটা ঘটনা ঘটলেও তাঁরা ছিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়।”
কেন? রেজিস্ট্রার প্রবীর দাশগুপ্তের অভিযোগ, ‘নির্দেশ নেই’ এই যুক্তি দেখিয়ে গোটা ঘটনায় নিষ্ক্রিয় থেকেছেন পুলিশকর্মীরা। অথচ টিএমসিপি মিছিল করবে জেনে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে এ দিন বেলা ১১টা থেকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রবীরবাবুর কথায়, “পুলিশ মূল দরজায় তালা দিয়ে রাখতে বলে। কিন্তু তার পরেও যা হল, তা নজিরবিহীন। একটা জ্যাভলিন পাওয়া গিয়েছে পদার্থবিদ্যা গবেষণাগারের কাছে। সেটা দিয়ে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। এ কি ভাবা যায়!” |
উপাচার্যের কাছে নিজেদের অসহায়তার কথা জানাচ্ছেন
ছাত্রছাত্রীরা। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার। |
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মিছিল।
বুধবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। |
|
রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তাও জানান, এ দিন পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল না। গোলমালের সময় হাতে গোনা ওই পুলিশকর্মীরা কিছু করেননি, করার মতো অবস্থাতেও ছিলেন না। যদিও ঘটনার পরে সাধারণ পুলিশকর্মীরা তো বটেই, পুলিশের বড় কর্তারা ঘটনাস্থলে যান। জোড়াসাঁকো থানার তরফে অবশ্য দাবি, এক দল যুবক জোর করে
ঢুকছে দেখে অফিসারেরা তাদের তাড়া করেছিলেন। কিন্তু ধরার আগেই ওই যুবকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢুকে তাণ্ডব চালায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দেবর্ষি চক্রবর্তী, বিবস্বান বসু-সহ কয়েক জন বহিরাগতদের মারে জখম হয়েছেন বলে অভিযোগ। দেবর্ষি বলেন, “ওরা ক্যাম্পাসে সাঁটা পোস্টার ছেঁড়ে, বোর্ড ভাঙে। আমাদের মারধর করে চলে যায় পদার্থবিদ্যার গবেষণাগারে। সেখানে ভাঙচুর চালায়।
এমনকী, এখানকার কিছু ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয়।” রেজিস্ট্রার প্রবীর দাশগুপ্ত জানান, হেরিটেজ ভবনের ওই ল্যাবরেটরিতে ছিলেন পদার্থবিদ্যার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। গণ্ডগোলে তিনি আহন হন।
এ দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাম্পাস জুড়ে উত্তেজনা। রেজিস্ট্রার, ডিন অফ স্টুডেন্টস-সহ বেশ কিছু অফিসার পরিস্থিতি সামাল দিতে মূল ফটকের সামনে উপস্থিত হয়েছেন। দেবর্ষির টি-শার্ট সামনের দিকে ছেঁড়া, ঠোঁটের একটা দিক ফোলা। দিন কয়েক আগে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম পদার্থবিদ্যার যে পরীক্ষাগারের
উন্নয়নে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গিয়েছেন, সেই বেকার ল্যাবরেটরির সামনেও ভাঙচুরের চিহ্ন স্পষ্ট। ক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের একটি দল পরে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বক্তব্য জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরা কেন কিছু করতে পারলেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। এক ছাত্রী বলেন, “এমনিতে পরিচয়পত্র না দেখালে ছাত্রছাত্রীদের ভিতরে ঢুকতে দেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীরা। অথচ আজ তাঁরা কিছুই করলেন না!”
এ প্রসঙ্গে প্রবীরবাবুর প্রতিক্রিয়া, “ছাত্রছাত্রীদের যথেষ্ট নিরাপত্তা না দিতে পারাটা আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু বহিরাগত গুন্ডা আটকাতে তো নিরাপত্তারক্ষী রাখা হয়নি। এ বার কি তা হলে সিআরপিএফ বা সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে?”
|
কেন আবার? |
|
তৃণমূলের প্রতিবাদী মিছিল চলেছে
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের দিকে। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপরে এ রকম আঘাত মানা যায় না। দু’টো দল একে অন্যের কাজের প্রতিবাদ করবে, মারপিট করবে, তার জের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভুগতে হবে কেন?
ঈপ্সিতা চট্টোপাধ্যায়|
স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
|
যারা ভাঙচুর চালাল, মারধর করল, এ সব করে কী পেল তারা? বাইরে থেকে আসা একটা রাজনৈতিক দলের লোকেদের সেই অধিকার দিলই বা কে? আর কত দিন এমন চলবে?
রন্তিদেব মুখোপাধ্যায়|
দ্বিতীয় বর্ষ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন হিংসাত্মক ঘটনা নিন্দনীয়। মন্ত্রীর উপরে এসএফআই-এর হামলা দুঃখজনক ছিল। কিন্তু তার প্রতিবাদে আজ যদি টিএমসিপি ভাঙচুর, মারপিট করে থাকে, সেটাও নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।
আবাহন দত্ত| দ্বিতীয় বর্ষ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় |
যা হয়েছে, ঠিক হয়নি। এ ভাবে একটা বিক্ষোভের প্রতিবাদের নামে ফের বিক্ষোভ করে ভাঙচুর করাটা মোটেই সমর্থন করা যায় না।
সুশোভন মণ্ডল|
তৃতীয় বর্ষ,আশুতোষ কলেজ |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, মারপিট হবে কেন? কিছু বলার থাকলে আলোচনায় বসা যায়। তবে এমনও হতে পারে, মন্ত্রীকে নিগ্রহে এসএফআই অভিযুক্ত বলে আজকের ঘটনাটাকে তারা বড় করে দেখাচ্ছে।
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়| স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় |
|
মঙ্গলবার দিল্লিতে অর্থমন্ত্রীকে হেনস্থার নিন্দা করে ডিজি পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন মহাকরণের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে তাঁর নিজের কলেজে যা ঘটল, তা নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। আর কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম সন্ধ্যায় লালবাজারে শুধু জানান, ডিসি (সেন্ট্রাল) ঘটনার তদন্ত করছেন। ডিসি (সেন্ট্রাল) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ রাতে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ জমা দিতে বলা হয়েছে। তার পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আজ, বৃহস্পতিবার পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দেবেন কর্তৃপক্ষ।
তৃণমূলের মহাসচিব ও রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন প্রথমে প্রেসিডেন্সির ঘটনাকে ‘ছোট’ ঘটনা বললেও সন্ধ্যায় এর নিন্দা করে বলেন, “প্রেসিডেন্সিতে টিএমসিপির কোনও ইউনিট নেই। দলের কেউ এতে জড়িত নন।”
বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “যা ঘটেছে তা অনভিপ্রেত। পুলিশ কেন গুণ্ডাদের আটকানোর কোনও ব্যবস্থা নিল না?” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের প্রশ্ন, “দিল্লিতে অমিত মিত্রের উপর হামলা কার অন্যায় হলে
প্রেসিডেন্সিতে যারা ভাঙচুর চালানোটা কি অন্যায় নয়?” এ দিন ভূগোলের শিক্ষক বাছাইয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেকশন কমিটির বৈঠক চলছিল। গোলমালের জেরে মাঝপথেই বৈঠক বন্ধ হয়ে যায়। বিকেলে ক্যাম্পাস কিছুটা শান্ত হওয়ার পরে ফের বৈঠক শুরু হয়। ওই বৈঠকে ছিলেন টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর শিক্ষিকা ও প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায় গুহ। তিনি বলেন, “এই প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু আজ যা হল, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক।” বৈঠকে উপস্থিত প্রেসিডেন্সির আর এক প্রাক্তনী, এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়েরও মত একই।
|
—নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|