দিল্লির ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটানোর জন্য দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে উঁচু স্তরের নেতারা। কার্যত সেই আবেদনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় সিপিএম পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালায় তৃণমূল। বুধবারও সিপিএম অফিসে হামলা, মারধর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা অব্যাহত। প্রতিবাদ মিছিল থেকে কোথাও দোকানে হামলার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। দোকানে হামলার প্রতিবাদে এ দিন ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ পালনও করেছেন। যদিও তৃণমূলের তরফ থেকে সব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
|
দিল্লিতে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীকে হেনস্থার প্রতিবাদ |
|
|
নানুরে সিপিএস কার্যালয়ে আগুন।
বুধবার ছবি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি |
বোলপুরে তৃণমূলের ধিক্কার মিছিল।
ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী |
|
দৃশ্য ১: জেলার অন্যান্য জায়গার মতো এ দিন সকালে প্রতিবাদ মিছিলের জন্য মোটরবাইক, ট্রাক্টরে করে তৃণমূল কর্মীসমর্থকেরা নানুরে জড়ো হয়। বাসস্ট্যান্ডে বাইক রেখে সাকুলিপুরে সিপিএম পার্টি অফিসের দিকে যায় তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। অভিযোগ ওঠে, ওই কার্যালয়ে ভাঙচুর করে আগুন ধরানোর পরে তারা বোমাবাজি করতে করতে কীর্ণাহারের দিয়ে বাইক নিয়ে চলে যায়। সেখান থেকে বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া সিটুর কার্যালয়, কীর্ণাহার ১ পঞ্চায়েত লাগোয়া আরএসপির শ্রমিক সংগঠনের অফিস ও সিপিএমের কীর্ণাহার লোকাল কমিটির অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে অভিযোগ। সিপিএমের কীর্ণাহার ১ পঞ্চায়েতের প্রধান কৃপাশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “নানুর থেকে আসার পথে রামকৃষ্ণপুর ক্যানাল লাগোয়া পাপুড়ি থেকে আসা আমাদের এক দলীয় কর্মীকে মারধর করেছে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা।”
সকাল ৯টা নাগাদ সাকুলিপুরে গিয়ে দেখা গেল, গ্রিলের তালা ভাঙা। আর একটি গেট ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। টিনের বাড়ির একতলার কড়িকাঠ জ্বলছে। পুড়ছে কাগজপত্র ও আসবাবপত্র। সামনের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে স্টোভ, গ্যাস ওভেন-সহ বিভিন্ন সামগ্রী। সিপিএমের নানুর জোনাল কমিটির সম্পাদক হাসিবুর রহমানের অভিযোগ, “তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা আমাদের বিভিন্ন কার্যালয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে।” অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূলের নানুর ব্লক কার্যকরী সভাপতি অশোক ঘোষ বলেন, “কোথাও কোনও তাণ্ডব চালায়নি, কাউকে মারধরও করা হয়নি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে সহানুভূতির হাওয়া পালে লাগাতে সিপিএম আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে।” এ দিন কালো ব্যানারে লাভপুরে প্রতিবাদ মিছিল করে তৃণমূল। সিপিএমের ময়ূরেশ্বর জোনাল কমিটির সম্পাদক অরূপ রায়ের অভিযোগ, “এ দিন সকালে মিছিল করার সময়ে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা আমাদের এক লোকাল কমিটির সদস্যের মোবাইল ও বাসনের দোকানে ভাঙচুর, লুঠপাট চালিয়েছে।” তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। |
সিউড়িতে হামলার পরে। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |
দৃশ্য ২: ময়ূরেশ্বর থানার মল্লারপুরে এক সিপিএম কর্মীর দোকানে ভাঙচুর, লুঠপাট চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এই ঘটনার প্রতিবাদে মল্লারপুর বাজার, বাহিনা মোড়-সহ বেশ কিছু জায়গায় ব্যবসায়ীরা বন্ধ পালন করেন। মল্লারপুর ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক তাপস দত্ত বলেন, “রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকবে। ব্যবসার জায়গায় ব্যবসা। এ দিন এক ব্যবসায়ীর দোকানে ভাঙচুর, লুঠপাট মেনে নেওয়া যায় না। এলাকার ব্যবসায়ীরা তাই ব্যবসা বন্ধ করার জন্য বলেছিলেন। তাতেই সাড়া দিয়ে এনেকে দোকান বন্ধ করে রেখেছেন। যাঁরা বহু দূর থেকে এসেছেন তাঁদের জন্য কিছু ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ করতে পারেননি।” দোকানে ভাঙচুরের ঘটনায় কেউ জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “রাজনীতি করার জন্য এখন ওরা এসব ঘটনা তৈরি করছে। ওরা অভিযোগ করলে আমরাও অভিযোগ করব।” মল্লারপুরের ঘটনায় এখনও কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা।
দৃশ্য ৩: মঙ্গলবার সিউড়িতে সিপিএমের জোনাল কার্যালয়ে ভাঙচুরের পরে বুধবারও পুরন্দরপুরে ধিক্কার মিছল করা ছাড়াও লোকাল অফিসে ভাঙচুর ও এক সিপিএম সদস্যকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। এ ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছেন সিপিএমের সিউড়ি জোনাল কমিটির সম্পাদক দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। যদিও পুরো ঘটনার কথা অস্বীকার করেছেন তৃণমূলের সিউড়ি ২ ব্লক সভাপতি নুরুল ইসলাম।
|
রামপুরহাটে মিছিলের ছবিটি তুলেছেন সব্যসাচী ইসলাম। |
দৃশ্য ৪: জেলার আর পাঁচটা জায়গার মতো দুবরাজপুরেও তৃণমূলের প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। সেখানে জোনাল পার্টি অফিস লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ার আভিযোগও ওঠে। এর জেরে কেউ জখম না হলেও এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন এলাকার মানুষ। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সাধন ঘোষের দাবি, “পরিকল্পনা করে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তৃণমূল। পাশের স্কুলটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাড়াতাড়ি। আমরা থানায় লিখিত আভিযোগ জানাচ্ছ।” দুবরাজপুরের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা প্রভাত চট্টপাধ্যায় বলেন, “দিল্লিতে যে নক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিবাদেই এই মিছিল ছিল। শান্তিপূর্ণ ভাবেই মানুষ যোগ দিয়েছিলেন।” তাঁর পাল্টা দাবি, “সিপিএম পার্টি আফিসের উপর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে প্ররোচনা দিয়েছিল বলেই দু’একটি ঢিল কেউ ছুড়ে থাকবে।” প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে সিপিএম।
দৃশ্য ৫: এ দিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দফায় দফায় বোলপুরের সিয়ান এলাকার সিপিএমের কোপাই লোকাল কমিটির তালা ভেঙে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে লাগোয়া একটি খাবাবারের দোকানের পাশে রাখা সিপিএম কর্মীর বাইক ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি সব পক্ষকে সংযম বজায় রাখার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। তাঁর আবেদন, “আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রে বিভিন্ন দল থাকবে, বিভিন্ন মতামত থাকবে। যে মতামত মানুষ গ্রহণ করবে, তাকে ক্ষমতায় বসাবে। তার জন্য যাঁরা ক্ষমতায় নেই, যাঁরা ক্ষমতায় আসতে চায় তাঁদের প্রতি এ ধরনের সংঘাতের রাজনীতি যেন না হয়।”
|
‘‘মারের বদলা মার দিয়ে কোনও দিন সমাধান হতে পারে না। দিল্লিতে যা ঘটেছে, তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং তারই প্রতিবাদে এখানে যা ঘটছে তারও প্রতিবাদ জানাছি। সকলকে সংযত হতে হবে। দেশের উন্নয়নে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। শান্তি বজায় রাখুন।’’
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার |
|
যদিও এ দিন কোথাও কোথাও দলের নেতারা অশান্তি আটকানোর চেষ্টা করলেও কর্মী-সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এই ঘটনা প্রসঙ্গে সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “তৃণমূল এ দিন নানুর, পুরন্দরপুর, মল্লারপুর, কীর্ণাহার, সিয়ান-সহ সমস্ত জায়গায় দলীয় কার্যালয়ে আগুন ভাঙচুর চালায়। কিছু কিছু জায়গায় আগুনও ধরিয়ে দিয়েছে।” তাঁর দাবি, “পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ওরা সর্বত্র আতঙ্ক ছড়াতেই এ সব করছে।” অন্য দিকে, তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বলেন, “ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়ে ওরাই মানুষের কাছ থেকে সমবেদনা পেতে চাইছে। সন্ত্রাস বা আতঙ্ক ছড়ানো সিপিএমের সংস্কৃতি।”
|