পাহাড়ের আনাচে কানাচে সিআরপি-র অবিরাম টহল। তৃণমূল, এমনকী জিএনএলএফের সভায় উপচে পড়া ভিড়। দল ছেড়ে নেতা-কর্মীদের একাংশ তো বটেই, ডুয়ার্সের এক মাত্র মোর্চা সমর্থিত বিধায়ক উইলসন চম্প্রমারিও যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে।
ঘরে-বাইরে এমন বিবিধ চাপের মুখে কার্যত কোণঠাসা বিমল গুরুঙ্গ এখন কেন্দ্রকে সামনে রেখে রাজ্যের সঙ্গে দুমড়ে যাওয়া সম্পর্ক খানিক মেরামতিতে মরিয়া। শনিবার, মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরির কথাতেও তা স্পষ্ট: “মনে রাখবেন, আমাদের সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ জানিয়েছেন, রাজনীতিতে চিরশত্রু বলে কিছু হয় না।” মোর্চার অন্দরের খবর, আজ, রবিবার দার্জিলিঙে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশের সঙ্গে বৈঠকে উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা ছাড়াও দ্রুত ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের আর্জি জানানো হবে। আর সে ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে রাজি করাতে কেন্দ্রকেই বাড়তি উদ্যোগী হওয়ার অনুরোধ করবে মোর্চা।
শনিবার দিল্লিতে জয়রামের কথাতেও তারই প্রতিধ্বনি, “দার্জিলিঙের উন্নয়ন নিয়ে কোনও রাজনীতি নয়। কেন্দ্র-রাজ্য-জিটিএ তিন পক্ষ আলোচনা করেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমি এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গে কথা বলব। কেন্দ্রের তরফে যা করা দরকার করা হবে।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, দার্জিলিং নিয়ে কোনও সংকীর্ণ রাজনীতি করতে বা ঝুঁকি নিতে তাঁরা চান না। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ের পরিস্থিতির প্রভাব দেশের অন্যত্রও পড়বে। সেখানে পৃথক রাজ্যের দাবি তীব্র হলে অন্যত্রও তা ইন্ধন জোগাবে। তাই এ ব্যাপরে মমতা যে কড়া অবস্থান নিয়েছেন, তাকে সমর্থন করার ব্যাপারেই কেন্দ্রের পাল্লা ভারী।
মাস দুয়েক আগে, দার্জিলিঙের ম্যালে তাঁর সরকারি অনুষ্ঠানে মোর্চা সমর্থকেরা গোর্খাল্যান্ডের দাবি তোলায় বেজায় চটেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নিজেকে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ বলে মন্তব্য করে রীতিমতো ধমক দিয়ে মোর্চা কর্মীদের বিক্ষোভ থামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ২৯ জানুয়ারির ওই ঘটনার পরে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতেই চলে গিয়েছিল মোর্চা। গুরুঙ্গ হুমকি দিয়েছিলেন, রাজ্যের সঙ্গে আর কোনও আলোচনায় যাবেন না। পাহাড়ে কয়েক দফায় বন্ধ, লাগাতার অফিস অচলের হুমকি ছুড়ে দিয়েছিল মোর্চা। কিন্তু, অনড় মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে সিআরপি, বাড়তি পুলিশ মোতায়েনের সিদ্ধান্তে অটল থেকে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে দেন।
কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি এবং দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর মালাকারের দৌত্যে এর পর কেন্দ্রের তরফে মোর্চার সঙ্গে আলোচনা হয় ঠিকই, কিন্তু রাজ্যকে এড়িয়ে কোনও পদক্ষেপ করা যে সম্ভব নয়, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছিল তারা। এর পরেই ধীরে ধীরে পিছু হটতে থাকে মোর্চা। প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় আন্দোলন। রাজ্যের তরফে বাড়তি পুলিশ, র্যাফ, ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়নের বাহিনী পাহাড়ে পাঠানো হয়। পুলিশ-প্রশাসন সক্রিয় হতেই পাহাড়ের মোর্চা-বিরোধী গোর্খা লিগ, জিএনএলএফ সভা-সমাবেশ শুরু করে।
এ হেন চাপের মুখে কোণঠাসা মোর্চা নেতারা সুর আরও নরম করছেন। গুরুঙ্গও প্রতিটি সভায় পাঁচ বছর জিটিএ চালিয়ে পাহাড়ের উন্নয়নের উপর জোর দিচ্ছেন। সম্প্রতি, তৃণমূল পাহাড়ে সংগঠন জোরদার করতে কোমর বেঁধে নামলেও ‘রাজনীতিতে কেউ চিরশত্রু নয়’ বলে ফের রাজ্যের শাসক দলের কাছাকাছি যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন তিনি।
মোর্চার মনোভাব আঁচ করে রাজ্যও ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। যেমন, জিটিএ-এর আর্জি মেনে দার্জিলিঙের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনকে জিটিএ-এর প্রধান সচিবের পদ থেকে সরিয়ে অন্য ‘সিনিয়র’ অফিসার নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবও বলেন, “পাহাড়ের একটি লোকসভা আসনের জন্য কেউ অশান্তি উস্কে দিতে চাইলে মুখ্যমন্ত্রী তা বরদাস্ত করবেন না। তবে পাহাড়ে শান্তি ও উন্নয়নের কাজে সহযোগিতা মূলক মনোভাবকে আমরা স্বাগত জানাব।”
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজ্যকে চাপে ফেলতে গিয়ে গত দু’মাসে প্রতি পদে বেকায়দায় পড়ে এখন দূরত্ব মোছার চেষ্টায় নেমেছেন গুরুঙ্গরা। বাম জমানায় সুবাস ঘিসিংয়ের আব্দার মেনে নেওয়া হতো বলেই পাহাড়ে একদলীয় শাসন কায়েম হয়েছিল। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর ‘কঠিন ও কঠোর’ মনোভাব সেই একাধিপত্যের ‘ট্রাডিশন’ ভেঙে গুরুঙ্গকে অনেকটাই পিছনে ঠেলেছেন। জয়রামের সঙ্গে আলোচনা গ্রামোন্নয়ন নিয়েই, জানিয়েও রোশন গিরির তাই সংযোজন, “সব কিছু নিয়ে খোলা মনেই কথার্বাতা হবে।”
আজ দুপুরে শিলিগুড়িতে একটি দলীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সেখান থেকে দার্জিলিং যাবেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী। বিকেলেই গোর্খা রঙ্গমঞ্চ ভবনে গুরুঙ্গ-সহ জিটিএ-র অন্যান্য পদাধিকারীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। জিটিএ সূত্রে খবর, পাহাড়ে যে হেতু এই মুহূর্তে কোনও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু নেই, সে জন্য গ্রামোন্নয়ন বাবদ টাকা কী ভাবে মিলবে তা নিয়ে পরামর্শ দেবেন জয়রাম। পাশাপাশি, রাজ্য সরকারের সঙ্গে কী কারণে দূরত্ব এবং তা কী ভাবে কমিয়ে ফের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যায়, সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া হবে বলে মোর্চা সূত্রের দাবি।
|