স্রেফ ‘কোটেশন’ এর ভিত্তিতে জোড়াপানি নদী সংস্কারের কাজে প্রায় ৯ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অন্তত ৫ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ত্রিফলা আলো লাগানোর কাজেও। অভিযোগ উঠেছে, মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যানে পাম্প কেনা, বিধাননগরে আনারস কেন্দ্র নির্মাণে অনিয়ম, কাওয়াখালি এলাকায় পাঁচিল তৈরি, রাস্তা চওড়া করার কাজে দুর্নীতি নিয়ে। অভিযোগের মুখে অপসারিত হয়েছিলেন শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) চেয়ারম্যান। এ বার ওই সব কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ৩ ইঞ্জিনিয়ারের পদাবনতি ঘটানো হল।
সদ্য নিযুক্ত চেয়ারম্যান উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব জানিয়েছেন, ওই অভিযোগগুলি নিয়ে বিশদে তদন্ত শুরু হবে। তবে তার আগেই কেন পদাবনতি ঘটানো হল এই ৩ জনের? বর্তমান কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ওই ৩ জনকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদ থেকে বিধি ভেঙে এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার করা হয়েছিল। সে কারণেই তাঁদের পদাবনতি ঘটানো হয়েছে।
গৌতমবাবু এই দিন বলেন, “ওই ৩ জন সহ এসজেডিএ-র মোট ৬ জন কর্মীর পদাবনতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই ৩ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেই ফের কাজ করবেন।” যে সব কাজ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে তা খতিয়ে দেখার কাজ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত বিতর্কিত প্রকল্পগুলির বকেয়া কোনও টাকা দেওয়া হবে না বলেও চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। বোর্ড মিটিঙের পরে ভবিষ্যতে ই-টেন্ডার বা টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়া বড় কোনও প্রকল্পের কাজ যাতে কোনও ভাবেই না করা হয় সে ব্যাপারে নির্দেশও দিয়েছেন মন্ত্রী। নতুন করে টেন্ডার কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে সদস্যদের কাউকে রাখা হয়নি। |
এসজেডিএ-র বোর্ড মিটিং চলছে। —নিজস্ব চিত্র। |
এসজেডিএ’র মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক এবং অন্যান্য বাস্তুকারদের রাখা হয়েছে। পূর্ত দফতরের সিভিল এবং বৈদ্যুতিক বিভাগের ২ আধিকারিককে সামিল করা হয়েছে।
এসজেডিএ সূত্রে জানা গিয়েছে, যে ৩ জন এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়রের পদাবনতি ঘটানো হল তাঁদের নাম মৃগাঙ্কমৌলি সরকার, গৌতম মজুমদার ও অনুপ মল্লিক। মৃগাঙ্কবাবু জোড়াপানি নদী সংস্কার, শ্মশানে বৈদ্যুতিক চুল্লি বসানোর কাজে ত্রিফলা আলো বসানোর মতো বিভিন্ন কাজে যুক্ত। গৌতমবাবু বিধাননগরে আনারস কেন্দ্র তৈরি, আনারস উৎসব সহ একাধিক রাস্তা, বালাসন নদীর উপর একটি সেতু তৈরির প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। কাওয়াখালি সহ নানা এলাকায় বিভিন্ন রাস্তা তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন অনুপবাবু। ওই সব কাজ নিয়ে বামেদের তরফে তো বটেই, তৃণমূলের তরফেও দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে। এমনকী, এসজেডিএ-এর কর্মী-অফিসার-ইঞ্জিনিয়রদের একাংশের আয়ের সঙ্গে সম্পত্তির সঙ্গতি রয়েছে কি না তা নিয়েও তদন্তের দাবি পৌঁছেছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর কাছে। শুধু তাই নয়, এসজেডিএ-র বোর্ড টাঙিয়ে কয়েকজন অফিসার-ইঞ্জিনিয়র একাধিক গাড়ির অপব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ গিয়েছে চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যান সব অভিযোগই খতিয়ে দেকার আশ্বাস দিয়েছেন।
আগের চেয়ারম্যান রুদ্রনাথবাবুর আমলে ওই তিন জন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়রের পদোন্নতি হয়। জোড়াপানি সংস্কারের কাজ দেখাশোনার অন্যতম দায়িত্বপ্রাপ্ত মৃগাঙ্কমৌলিবাবু বলেন, “অফিস থেকে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। এ সব নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।” আনারস উৎসব সহ নানা খাতে বহু কোটি টাকার প্রকল্প রূপায়ণের কাজের নানা দায়িত্বে ছিলেন যিনি সেই গৌতম মজুমদারের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও তিনি মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, “এখনই এ সব নিয়ে কিছু বলব না।” এসজেডিএ-এর আর একজন ইঞ্জিনিয়ার অনুপবাবুর বিরুদ্ধেও একাধিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে বলে সংস্থা সূত্রের খবর। যদিও অনুপবাবুও বলেছেন, “অভিযোগ ঠিক নয়। আমাদের পদোন্নতি খারিজের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব। তার পরেই যা বলার বলব।” কার্যনির্বাহী বাস্তুকাররা ছাড়াও ৩ জন জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট প্ল্যানারের পদোন্নতি খারিজ করে আগের প্ল্যানিং অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে বহাল করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় মার্চ মাসের মাঝামাঝি মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের শেষ দিন চেয়ারম্যান পদ থেকে রুদ্রনাথবাবুকে সরানো হয়। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী দায়িত্ব পান। এখনও রুদ্রনাথবাবু এসজেডিএ-এর সদস্য। তিনি বোর্ড মিটিঙে অনুপস্থিত ছিলেন। পরে রুদ্রনাথবাবু বলেন, “আমিও জোড়াপানি সংস্কারের কয়েক কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ পেয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর পরামর্শে তদন্ত শুরু করিয়েছিলাম। মৃগাঙ্কমৌলি সরকারকে জলপাইগুড়িতে বদলির নির্দেশ দিয়েছিলাম। যাই হোক, ওই সব কাজ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি।” প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা এসজেডিএ-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান অশোক ভট্টাচার্য অবশ্য এসজেডিএ-র কাজকর্ম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “কয়েকজন বাস্তুকারের পদোন্নতি খারিজ করলেই হল না। এই সব অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে অনেকেই যুক্ত। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করা হোক।” |