গার্ডেনরিচে পুলিশ-হত্যার ২৩ দিন বাদে গ্রেফতার হয়েছিলেন তৃণমূলের বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না। ধাপায় তৃণমূল নেতা হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত কলকাতা পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও ধরা পড়লেন ঘটনার ১৫ দিন পর।
একের পর এক জায়গায় ঘাঁটি বদল করে মুন্নাভাই ধরা পড়েছিলেন বিহারের ডেহরি অন শোন থেকে। একই কায়দায় এই ক’দিন চোর-পুলিশ খেলার পর কাও ধরা পড়লেন উত্তরপ্রদেশের এক গ্রাম থেকে। কলকাতায় এক মোবাইল নম্বরে ফোন করেছিলেন কাও। পুলিশের ধারণা, ট্যাঁকে টান পড়াতেই এই ফোন। তারই সূত্রে জালে পড়লেন কাও।
ধাপার মাঠপুকুর এলাকায় একটি বহুতল নির্মাণকে কেন্দ্র করে দলীয় কোন্দলে স্থানীয় তৃণমূল নেতা অধীর মাইতি নিহত হন গত ২০ মার্চ। সেই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাও। ১৫ দিন ধরে এ-রাজ্য ও-রাজ্য করে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বালিয়ায় সিকন্দরপুর থানার মাতুরি গ্রামের একটি বাড়ি থেকে কাওকে পাকড়াও করেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা অফিসাররা। শুক্রবার দুপুরে বালিয়া সিজেএম আদালতে তাঁকে হাজির করিয়ে ট্রানজিট রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। বিচারক ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ধৃতের ট্রানজিট রিমান্ডের নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ সূত্রের খবর, এর পরই গোয়েন্দারা সড়কপথে কলকাতা রওনা দিয়েছেন কাওকে নিয়ে। এ দিন রাতেই কলকাতায় ধর্মতলা এলাকা থেকে কাওয়ের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতের নাম শ্যামল মুখোপাধ্যায়। |
দলীয় কাউন্সিলরের গ্রেফতারের খবর শুনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “পুলিশের নজর এড়িয়ে কোথায় পালাবে! শুধু একটু সময় লাগল ধরতে।” তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, মুন্না এবং কাও, দু’জনকেই আত্মসমর্পণ করতে বলেছিল দল। কিন্তু কেউই তা শোনেননি। তাই গ্রেফতার করতে হল। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু আলিপুরদুয়ারে এক সাংবাদিক বৈঠকে মন্তব্য করেন, “মুখ্যমন্ত্রী নিজেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি গ্রেফতার করার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও কাওকে ধরতে এত দেরি হল কেন, তা বোঝা যাচ্ছে না।” পুলিশের গাফিলতি রয়েছে কি না সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পুরনো দিনের কথায় রয়েছে চোরকে বলো চুরি কর, আর গৃহস্থকে সজাগ থাকতে বলো। এতেই বোঝা যায় কেন পুলিশ শম্ভুকে ধরতে দেরি করল।”
শম্ভুনাথের গ্রেফতারের খবর জানাতে এ দিন দুপুরে লালবাজারে সাংবাদিক বৈঠক করেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ। তিনি জানান, গত শনিবার জিঞ্জিরাবাজারে কাওয়ের এক আত্মীয় ও বন্ধুর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু তথ্য মিলেছিল। সেই সূত্রেই ‘সোর্স’ মারফত খবর পেয়ে বালিয়ায় হানা দেওয়া হয়। সেখানে মিন্টু খান নামে এক জনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন শম্ভুনাথ। তাঁর কাছ থেকে নগদ ২৮ হাজার টাকা ও ৩টি মোবাইল ফোন উদ্ধার হয়েছে।
কী ভাবে ধরা পড়লেন শাসক দলের এই দাপুটে কাউন্সিলর?
পুলিশ সূত্রের খবর, ঘটনার দিন দুপুরেই গা-ঢাকা দেন কাও। পরের ক’দিন কলকাতার কয়েকটি এলাকায় আত্মীয়-পরিচিতদের বাড়িতে লুকিয়ে থাকলেও তাঁকে ধরতে পারেনি পুলিশ। গত শনিবার জিঞ্জিরাবাজারে শ্যালিকার ছেলে দেবাশিস সরকারকে গ্রেফতার করার পরে পাখি উড়ে যায় ভিন্ রাজ্যে। প্রথমে ওড়িশা, তার পরে বিহার-ঝাড়খণ্ড ঘুরে উত্তরপ্রদেশ। তদন্তকারী এক অফিসার জানান, কলকাতায় থাকাকালীন অনেক বার তাঁর নিশ্চিত অবস্থান জানা সত্ত্বেও পুলিশ ধরতে পারেনি শম্ভুনাথকে। যে ভাবেই হোক, পুলিশ যাওয়ার আগেই খবর পৌঁছে যাচ্ছিল তাঁর কাছে। সেই মতো ডেরা বদল করছিলেন। |
পুলিশের এক কর্তা জানান, শ্যালিকার ছেলে ধরা পড়ার পর তাঁকে এবং শম্ভুনাথের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ভিন্ রাজ্যে ব্যবসায়িক যোগাযোগের কথা জানতে পারেন গোয়েন্দারা। সেই সূত্র ধরে শুরু হয় নজরদারি। তাঁর সন্ধানে ওড়িশা, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে তল্লাশি চালিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয় গোয়েন্দাদের। গার্ডেনরিচের মুন্নার মতোই শম্ভুনাথও মোবাইল থেকে বা কোনও মোবাইল নম্বরে ফোন করছিলেন না। পাছে নম্বর বা টাওয়ারের অবস্থান পুলিশ জেনে যায়। কিন্তু পালানোর সময় তাঁর কাছে লক্ষাধিক টাকা থাকলেও ক্রমশ তা ফুরিয়ে আসছিল। সম্ভবত সে কারণেই শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার সন্ধেয় কলকাতায় এক পরিচিতের মোবাইলে ফোন করে বসেন শম্ভুনাথ। সেই ফোনের সূত্রেই তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যান গোয়েন্দারা। সে রাতেই লালবাজারের গুন্ডাদমন শাখার ৮ অফিসার দু’টি গাড়ি নিয়ে বালিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন।
কলকাতা ছাড়ার পর দেওঘর, পটনা ঘুরে বুধবার রাতে বালিয়া পৌঁছয় গোয়েন্দা দলটি। বৃহস্পতিবার সকালেই সিকন্দরপুরের কাছে মাতুরি গ্রামটি খুঁজে বার করেন তাঁরা। ছোট্ট গ্রাম, সবাই একে অন্যকে চেনেন। গ্রামের লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই গোয়েন্দারা খবর পান, মিন্টু খানের দোতলা বাড়িতে এক নতুন অতিথি এসেছেন। দেখতে বাঙালিদের মতোই। কেল্লা ফতে তাতেই। |
কাও-কথা |
কে শম্ভুনাথ |
কলকাতা পুরসভার ৫৮ ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর আগে
ছিলেন কংগ্রেসে,
২০০৬-এ তৃণমূলে বছর চারেক আগে বাড়িতে
অ্যাসবেস্টসের ছাদ এখন বাড়ি তিনতলা, মার্বেল বসানো |
পেশা |
তল্লাটে অভিযোগ |
ধাপায় প্লাস্টিক-লোহা কুড়িয়ে
বেচতেন ক্রমে ছাঁট চামড়ার কারবারে
শেষে বাইপাসে জমির দালালি |
তোলাবাজি, জুলুম-রাজ,
চাষিদের জমির অবৈধ কেনা-বেচা,
ভেড়ির বেআইনি বিক্রি |
|
পুলিশ খুঁজছিল কেন |
মাঠপুকুরে তৃণমূল নেতা অধীর মাইতি হত্যায় |
কোন ধারায় অভিযুক্ত |
|
৩০২: খুন
৩০৭: খুনের চেষ্টা
১৪৭: হাঙ্গামা পাকানো
১৪৮: মারণাস্ত্র নিয়ে হাঙ্গামা
১৪৯: বেআইনি সমাবেশ |
|
|
সব দিক থেকে নিশ্চিত হয়েই স্থানীয় পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে বৃহস্পতিবার মাঝরাতে মিন্টু খানের বাড়িতে হানা দেন লালবাজারের অফিসাররা। একতলার একটি ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন মাঠপুকুরের কাউন্সিলর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁকে ঘিরে ফেলে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, পুলিশকে দেখে প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন শম্ভুনাথ। তবে পালানোর পথ নেই বোঝার পরে গোয়েন্দাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন তিনি। যদিও নিজেকে নির্দোষ বলেই দাবি করেছেন পুলিশের কাছে। শম্ভুনাথের দাবি, এই ঘটনায় জোর করে তাঁর নাম জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, ভিন্ রাজ্যে ব্যবসায়িক যোগাযোগ না থাকলে এত দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারতেন না কাও। বিহার, উত্তরপ্রদেশের কয়েক জন পরিচিতই তাঁকে এত দিন আশ্রয় জুগিয়েছেন। মিন্টু খানও তেমনই এক জন। কলকাতায় কাওয়ের আশ্রয়দাতা হিসেবে দু’-তিন জন তৃণমূল নেতার নামও উঠে এসেছে বলে পুলিশ সূত্রের দাবি।
কাওয়ের গ্রেফতারের খবর শহরে আসতেই দু’বাড়ির দুই ছবি। বাড়ির লোক বালিয়ায় ধরা পড়েছেন জেনেই এ দিন দরজা-জানলায় কপাট লাগিয়ে দেন কাও-পরিবারের লোকেরা। বাইরের কারও সঙ্গে তাঁরা কথা বলবেন না বলে জানিয়ে দেন পাড়ার লোকেরাই। অন্য দিকে, কাওয়ের গ্রেফতারের খবরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে নিহত অধীর মাইতির পরিবার। অধীরবাবুর স্ত্রী ধৃতের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দাবি করেছেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, বছর কুড়ি আগেও ধাপা থেকে বাতিল প্লাস্টিক, লোহালক্কড় কুড়িয়ে বিক্রি করে সংসার চালাতেন শম্ভুনাথ। কলকাতা পুরসভার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার আগে ট্যাংরার ছাঁট চামড়া কেনাবেচা, পরে বাইপাসের ধারে জমির দালালি করে টাকা কামাতে শুরু করেন।
ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তৃণমূলের এক শীর্ষস্থানীয় নেতার। সেই সুবাদেই ২০০৯-এর পুরভোটে কাউন্সিলর হন। প্রতিপত্তিও বাড়তে থাকে শম্ভুনাথের। শুরু হয় ব্যবসায়ী ও জমির দখলদারদের কাছ থেকে তোলাবাজি। সেই সব যোগাযোগই শেষ পর্যন্ত ধরিয়ে দিল তাঁকে।
|