বনধের ডায়েরি
তালা হাতে তড়িঘড়ি
আদ্রা রেলশহরের পাশে নিগম নগর হাইস্কুল বন্ধ নিয়ে রীতিমতো উত্তেজনা। বেলা ১১টা নাগাদ স্কুলের সামনে যে সংখ্যায় ছাত্রছাত্রী উপস্থিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। ব্যাপারটা কী? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে স্কুলে আসেননি শিক্ষকরা। অথচ স্কুল যে বন্ধ রাখা হবে, আগাম জানানো হয়নি পড়ুয়াদের। উত্তেজিত তৃণমূল কর্মীরা ঘনঘন ফোন করছেন বিধায়ক থেকে মন্ত্রী ও পুলিশ-প্রশাসনকে। সিপিএম সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার প্রাক্তন স্কুল খোলা রাখার দায় যেন তাঁদের উপরেই!
বনধেও খোলা স্কুল। রোজকার মতোই বুধবারও বিষ্ণুপুরের
বেলশুলিয়ায় মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রে এসেছিল পড়ুয়ারা। —নিজস্ব চিত্র।
খবর পেয়ে আদ্রা ও রঘুনাথপুর থানা থেকে এলেন দুই ওসি-সহ পুলিশ কর্মীরা। প্রধান শিক্ষক সুকুমার চক্রবর্তী জানান, যে সব দাবিতে বন্ধ ডাকা হয়েছে, শিক্ষকরা সেগুলিকে সমর্থন করেই এ দিন ক্লাস না করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খোঁজ শুরু হল চাবির। শেষ পর্যন্ত চাবি নিয়ে তড়িঘড়ি স্কুলে এলেন পরিচালন সমিতির সভাপতি অনিল সহিস। প্রধান শিক্ষকের দফতরের তালা খুলল। বিজয় গর্বে ফিরলেন তৃণমূল কর্মীরা। ভাবটা যেন, “পড়া হল না ঠিকই, স্কুল খোলানোই বা কম কী?”

গ্রেফতার নেই
বনধ নির্বিঘ্ন থাকায় দিনের শেষে হাসি ফুটেছে বাঁকুড়া জেলার পুলিশ কর্তাদের মুখে। পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, “এ বারের বনধে ঝামেলা, অশান্তি কিছুই নেই। তাই গ্রেফতারও নেই।” একই ছবি পুরুলিয়ায়। পুলিশ সুপার সি সুধাকর বললেন, “এমন শান্তির বনধ অনেক দিন হয়নি। ফলে কাউকে ধরাও হয়নি।” দুই জেলারই একাধিক পুলিশকর্তার মতে, গোলমাল হবে কী করে? যুযুধান কোনও পক্ষই তো সে ভাবে মাঠে নামেনি! অথচ এক বছর আগের ফ্রেবুয়ারিতে এমনই এক সাধারণ ধর্মঘটে বনধ বিরোধী ও বন্ধ সমর্থকদের মধ্যে মিছিল বের করা নিয়ে ছিল টানটান উত্তেজনা। দুই জেলাতেই নানা জায়গায় সংঘর্ষ বাধার উপক্রম হয়েছিল। এ বার সব শান্ত। আদ্রা স্টেশন লাগোয়া দোকানে চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে এক পুলিশকর্মীর মন্তব্য, “দিনভর টো টো করলাম। মিছিল তো দূর, কেউ স্লোগানও দিল না!”

রাজ্য সরকার পরিবহণ ব্যবস্থা সচল রাখার আশ্বাস দিলেও বাস মিলল হাতে গোনাই।
বাঁকুড়ার গোবিন্দনগরে অভিজিৎ সিংহের তোলা ছবি।

‘বিশ্বাসঘাতক’
পুরুলিয়ার নিতুড়িয়ার কয়লাখনিগুলিতে বনধ হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর ছিল সকলের। যে ১১টি সংগঠন শিল্প ধর্মঘট ডেকেছে, তাদের ভালই প্রভাব রয়েছে কয়লা শিল্পে। ইসিএলের চিফ ম্যানেজার(মাইনিং)এম কে জোশী অবশ্য জানান, দুবেশ্বরী কয়লাখনিতে কর্মীদের উপস্থিতির হার স্বাভাবিক ছিল। পারবেলিয়াতে ৮০ শতাংশ কর্মী কাজে এসেছিলেন। দু’টি খনিতেই স্বাভাবিক উৎপাদন হয়েছে। দিনের শেষে বনধ ডাকা এক সংগঠনের নেতার ক্ষোভ, “বিশ্বাসঘাতকতা করে কিছু কর্মী কাজে যোগ দেওয়ায় প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যায়নি। আর পুলিশ গিয়ে পিকেটিং উঠিয়ে না দিলে বনধ সফল হতই।” সাঁওতালডিহিতে বিসিসিএলের ভোজুডি কোল ওয়াশারিতে অবশ্য মাত্র তিরিশ শতাংশ কর্মী উপস্থিতি ছিল। জানালেন প্রজেক্ট ম্যানেজার রাজেন্দ্রপ্রসাদ যাদব। এক বনধ সমর্থকের কথায়, “ইসিএলে মুখ পুড়লেও মান রক্ষা করেছে বিসিসিএল।”

‘নির্মম’ পুলিশ
বাঁকুড়া জেলার শিল্পাঞ্চলগুলিতে মোটের উপর স্বাভাবিক কাজকর্ম হয়েছে বুধবার। ঝামেলা এড়াতে মোতায়েন ছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী। ফলে যকারখানার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি বনধ সমর্থনকারীরা। বারবার কারখানার মূল দরজায় বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে আটকে পড়ে মেজাজ হারিয়ে সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুজয় চৌধুরী বলে ফেললেন, “এই পুলিশ নির্মম। আমাদের কারখানার ধারেপাশেও যেতে দিচ্ছে না। বনধ কী ভাবে করব?” সিপিএম পুলিশকে দুষলেও তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি অরূপ চক্রবর্তীর দাবি, “সচেতন সাধারণ মানষের সমর্থন না পেয়েই বিফল হল বনধ।”

পুরুলিয়ায় স্বাভাবিক ছিল সব্জি বাজার। ছবি: সুজিত মাহাতো।
এ-ও পরিবর্তন
যে কোনও বনধেই আদ্রা-আসানসোল শাখার মুরাডি ও মধুকুন্ডা স্টেশন নিয়ে মাথাব্যথা থাকে আদ্রা রেল ডিভিশনের। কারণ, প্রতি বন্ধেই ওই দুই স্টেশনে রেল অবরোধ হওয়া কার্যত নিয়মে দাঁড়িয়েছে। এ বারই ব্যতিক্রম। আদ্রা ডিভিশনের কোন স্টেশনেই অবরোধ হয়নি। মাঝে রাজ্য পুলিশ সোর্স মারফত একবার খবর আসে, ওই দুই স্টেশনে অবরোধের প্রস্তুতি চলছে। পাল্টা প্রস্তুতি করেছিল রেলও। শেষ পর্যন্ত অবরোধ হয়নি। আদ্রার রেলের এক আধিকারিক বলেন “মুরাডি, মধুকুন্ডায় অবরোধ হয়নি। এটাও দেখছি এক ধরনের পরিবর্তন!”

হাজিরা বেশি
বুধবার বাঁকুড়ায় জেলাশাসকের দফতরে ঢুকে বোঝার উপায় ছিল না যে বনধ চলছে। অন্যান্য দিন অফিসে তবু কিছু চেয়ার ফাঁকা দেখা যায়। এ দিন শূন্য চেয়ার প্রায় চোখেই পড়েনি। যা দেখে অতিরিক্ত জেলাশাসক মৌমিতা বসু বলেই ফেললেন, “এ দিনের কর্মী হাজিরা অন্য সব দিনকে ছাপিয়ে গিয়েছে। ৯২ শতাংশ কর্মীই হাজির।” তা হলে হাজিরা বাড়ানোর দাওয়াই হিসেবে রোজ বনধ হলে কেমন হয়? উত্তরে মুচকি হাসলেন মৌমিতাদেবী।

বাসি খাবার
বন্ধের দিন দোকান খুলবে না ভেবে এক দিন আগেই বাজারহাট সেরে ফেলেছিলেন বাঁকুড়া শহরের কাঠজুড়িডাঙার বাসিন্দা, পেশায় শিক্ষক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। বুধবার সকালে মাচানতলায় এসে তিনি হতভম্ব। দোকান-বাজার সবই তো খোলা! তাঁর আক্ষেপ, “বিলকুল বোকা বনে গেলাম। ফালতুই বাসি সব্জি আর মাছ খেয়ে দিন কাটল।”

রাতে অফিসেই
রঘুনাথপুরে ডিভিসি-র নির্মীয়মাণ তাপবিদ্যুৎ কারখানায় বুধবার কাজে যোগ দেননি বেশিরভাগ ঠিকা শ্রমিক। মূল গেটের সামনে পিকেটিং ছিল বনধ সমর্থকদের। ইএফআর জওয়ানদের সঙ্গে তাঁদের সামান্য বচসাও বাধে। এমন হতে পারে, আঁচ করে ডিভিসি-র কিছু পদস্থ আধিকারিক রাত কাটিয়েছিলেন বিদ্যুৎকেন্দ্রর অফিসার্স ডরমেটরিতে। এ দিন দফতরে বসে কাজ সারলেন তাঁরা।

(তথ্য: শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল ও রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.